সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

নিজাম উদ্দিন আহমদ

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সারারাত নিজাম উদ্দিন আহমদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাটান। ভোরের আলো ফোটার আগেই তিনি একটা ছোট ট্রানজিস্টার নিয়ে বাইরে যাবার জন্য তৈরি হন। স্ত্রী রেবা তাঁকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিজাম উদ্দিন আহমদ বলেন, 'এখন কি ঘরে বসে থাকার সময়?' আমাকে বাইরে গিয়ে দেখতে হবে কোথায় কী হলো; তাছাড়া আমার অফিসে টেলিপ্রিন্টারের অপারেটর ও অন্যান্য লোকজন আছে, তাদের খোঁজ নিতে হবে।' এই বলেই তিনি বেরিয়ে যান। সারাদিন ঘুরে দেখেন ঢাকা শহরে পাকবাহিনীর বর্বরতা। মৃত্যু উপত্যকায় দাঁড়িয়েই তিনি সংগ্রহ করেন গণহত্যার সংবাদ। আবার যথাসময়ে সেগুলো পাঠিয়েও দেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বিবিসি'র সংবাদদাতা হিসাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর এই সংবাদ পাঠানোর জন্যই নিজাম উদ্দিন আহমদ পাকিস্তানী ঘাতকদের রোষানলে পড়েন, তাঁকে হত্যা করা হয়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের নয়টি মাস যিনি নির্ভীক সৈনিকের মতো নানা জায়গায় ঘুরে খবর সংগ্রহ করেছেন এবং বিবিসি'র মাধ্যমে তা বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন, স্বাধীনতা লাভের মাত্র চারদিন আগে সেই নিজাম উদ্দিন আহমদ নিজেই পরিণত হলেন খবরে। নিজাম উদ্দিন আহমদ যে যুদ্ধের কাহিনী নিয়ে নির্ভীকভাবে রিপোর্ট করছিলেন সেই যুদ্ধে বাংলাদেশিদের বিজয়ের খবর বিশ্ববাসীর কাছে তিনি পাঠাতে পারেননি। এর আগেই তাঁকে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর তাঁর হত্যাকান্ড নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। বিবিসি'র মার্ক টালিসহ অনেক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক এব্যাপারে খোঁজ-খবর করেছেন। কিন্তু হত্যাকান্ডের আজো বিচার পায়নি তাঁর পরিবার।
নিজাম উদ্দিনের মৃত্যুর পর বিবিসি তাঁর পরিবারের জন্য একটি ট্রাস্ট তহবিল গঠন করে। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সরকার এই কৃতিমান সাংবাদিককে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করলে বিবিসি সেদিন নিজাম উদ্দিনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে উল্লেখ করে - 'এই ঘোষণা এমন একজন সাংবাদিকের কাজের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত স্বীকৃতি, যিনি কর্তব্যের প্রতি আনুগত্যের মূল্য দিয়েছেন নিজের জীবন দিয়ে।'
২৬ মার্চ বিকেল বেলায় নিজাম উদ্দিন যখন বাসায় ফিরলেন তখন তাঁর মুখটা ছিল কালো। স্ত্রীকে বললেন, 'রাস্তায় রাস্তায় লোক মরে পড়ে আছে। ওরা বর্বরের মতো ঘরে ঘরে ঢুকে মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে মেরেছে। কোর্টের ভিতর ঢুকেও গুলি চালিয়েছে।' মূলত ২৬ মার্চ থেকেই তিনি যেন বাঙালীর মুক্তি সংগ্রামের জন্য নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন। সংবাদ মাধ্যমে নতুন করে মুক্তিযুদ্ধকে সংগঠিত করার জন্য আত্মনিয়োগ করেন।
ঢাকায় তখন অনেক বিদেশি সংবাদ সংস্থার সাংবাদিক কর্মরত ছিল। তিনি তাদের হাতে তুলে দিতেন মুক্তি-সংগ্রামের সব তাজা খবর। নিউইয়র্ক টাইমস-এর সাংবাদিক ম্যাক ব্রাউনসহ অনেক বিদেশি সাংবাদিককে গণহত্যার যথার্থতার প্রমাণ ও প্রামান্য ছবি সংগ্রহের জন্য মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যেতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই ধরনের কাজের জন্য অনেক সময়ই তাঁকে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। তবু দেশমাতৃকার টানে তিনি যেন সব ভুলে গিয়েছিলেন। তখন পাকবাহিনী সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে কড়া সেন্সরশিপ আরোপ করে। নিজাম উদ্দিন আহমদ কড়া সেন্সরশিপের ভিতরেও কৌশলে বহু তথ্য বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে অবহিত করতেন।
রাজধানী ঢাকা তখন ইয়াহিয়ার স্বর্গরাজ্য। কৌশলে কাজ করতে গিয়েও ঠিকই পাক গোয়েন্দাদের চোখে পড়ে যান নিজাম উদ্দিন আহমদ। ঢাকায় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা, ভারতে অবস্থানরত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ ইত্যাদি কারণে তাঁকে দু'বার জেনারেল রাও ফরমান আলীর দপ্তরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যেতে হয়। নিজাম উদ্দিন আহমদ রাও ফরমান আলীর দপ্তর থেকে ফিরে সবকিছু নিজের ছোট ভাই মিনহাজ উদ্দিন আহমদকে জানাতেন। রাও ফরমান আলী দু'বারই নিজাম উদ্দিন আহমদকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, 'কোনো অবস্থাতেই যেন গণহত্যার কোনো খবর বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে প্রেরণ করা না হয়। যদি এর অন্যথা হয় তবে তাঁকে সমস্যায় পড়তে হবে।' নিজাম উদ্দিন আহমদ এসব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে নিজের মতো করেই সংবাদ পাঠাতে থাকেন। তবে সেসময় মাঝে মাঝেই তিনি নিজের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে রাতে বাসায় না থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থাকতেন।
একসময় তাঁকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে ডেকে পাঠানো হয়। পিপিআই-এর আরেকজন সাংবাদিক ও একজন ব্যাংকারকেও একই কারণে ডেকে পাঠায় পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ। কৌশলে নিজাম উদ্দিন আহমদ সেখানে না গেলেও অন্য দু'জন যেতে বাধ্য হন। তার মধ্যে ব্যাংকারকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে বাধ্য করে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে শত্রু তাঁকে ঠিকই চিনে ফেলেছিল। শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। ১২ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী যেন সেই সুযোগই কাজে লাগায় তাদের এদেশীয় রাজাকার-আলবদরদের সহায়তায়।
শহীদ নিজাম উদ্দিন আহমদের জন্ম ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুন্সিগঞ্জ জেলার মাওয়া গ্রামে। বাবা সিরাজউদ্দিন আহমদ এবং মা ফাতেমা বেগম। পিতা-মাতার চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। অন্য ভাই-বোনেরা হলেন সুলতান উদ্দিন আহমদ, মিনহাজ উদ্দিন আহমদ এবং একমাত্র বোন সুরাইয়া বেগম ডালিম। নিজাম উদ্দিন আহমদের পারিবারটি ছিল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে অনেকখানি অগ্রসর। স্কুলে পড়ার সময় পরিবারের সব সদস্য মিলে বাড়িতে নাটক-গান-আবৃত্তি করতেন।
বাবা সিরাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন জাহাজের অডিট অফিসার। নিজাম উদ্দিন আহমদের চাচা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের একজন প্রখ্যাত ভূতাত্ত্বিক, তিনি দীর্ঘদিন ঢাকার আরমানিটোলা হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ছেলেবেলায় নিজাম উদ্দিন আহমদের লেখাপড়া শুরু হয় গ্রামেরই মাওয়া প্রাইমারি স্কুলে। এই স্কুলটি তাঁদের পরিবারের উদ্যোগেই তৈরী করা। পরে স্থানীয় কাজির পাগলা এ.টি ইনস্টিটিউশন-এ দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। ১৯৪৬ সালে বিক্রমপুর ভাগ্যকূল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি. পাশ করেন।
তিনি মুন্সিগঞ্জের সরকারি হরগঙ্গা কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫১ সালে স্নাতক সম্মান ডিগ্রী এবং ১৯৫২ সালে তিনি এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। স্কুলে পড়াকালীন সময়েই তিনি ছিলেন একজন তুখোড় সাঁতারু। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখেন। সাঁতারে বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যাম্পিয়ান হিসাবে নিজাম উদ্দিন আহমদ ছিলেন সকলের প্রিয়। প্রাদেশিক প্রতিযোগিতায়ও পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন প্রাদেশিক টিবি সমিতির একজন সক্রিয় সমর্থক।
হরগঙ্গা কলেজে পড়ার সময় নিজাম উদ্দিন আহমদ সরাসরি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। কলেজে তাঁর সহপাঠী ছিলেন তত্‍কালীন আওয়ামী লীগ নেতা কোরবান আলী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ। রাজনীতির কারণে তখন তিনি মুন্সিগঞ্জের আনাচে-কানাচে চষে বেড়িয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর অবশ্য তিনি আর সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেননি। সাংবাদিকতা, সাঁতার আর সাংস্কৃতিক অঙ্গন নিয়েই বেশি মেতে থাকেন। তবে সাংবাদিক জীবনে প্রবেশ করার পর তিনি আবার রাজনৈতিক জীবনে ফিরে আসেন। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন সেই নির্বাচনে ১৯৬৫ সালে নিজাম উদ্দিন আহমদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়েই নিজাম উদ্দিন আহমদ সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৫০ সালে করাচির 'সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট' পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি 'দৈনিক মিল্লাত', 'দৈনিক আজাদ', 'ঢাকা টাইমস', 'পাকিস্তান অবজারভার', 'এপিপি', 'এএফপি', 'রয়টার', 'ইউপিআই' ইত্যাদি পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থায় কাজ করেন। ১৯৫৮ সালে 'এপিপি'-র পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র ও প্রথম প্রতিনিধি নিযুক্ত হন। ১৯৫৯ সালে তদানীন্তন 'পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল (পিপিআই)' সংবাদ সরবরাহ সংস্থায় যোগ দেন। তখন 'পিপিআই'-এর ঢাকায় কোনো অফিস ছিল না। বাসা থেকে নিজে সাইকেল চালিয়ে গিয়ে টেলেক্স ও টেলিগ্রামের মাধ্যমে করাচি হেড অফিসে খবর পোস্ট করে আসতেন। 'পিপিআই' ঢাকা অফিস তাঁর নিজের হাতে গড়া। ১৯৬৪ সালে তিনি 'পিপিআই'-এর সম্পাদক হন। ১৯৬৯ সাল থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ওই সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। 'পিপিআই'-এ কাজ করার সময় তিনি অনেক বিদেশি সংবাদ সংস্থায়ও সংবাদ সরবরাহ করতেন। 'পিপিআই' অফিসটি ছিল অনেক আওয়ামী লীগ নেতার সান্ধ্যকালীন আড্ডার নিয়মিত স্থান। ঘন্টার পর ঘন্টা এখানে রাজনৈতিক আলোচনা হতো।
নিজাম উদ্দিন আহমদ মুন্সিগঞ্জের এক রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে কহিনূর আহমদ রেবার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পত্তির তিন সন্তান। বড় মেয়ে শামানা নিজাম। মেঝ মেয়ে শারমিন নিজাম রীমা (নির্মম হত্যাকান্ডে স্বামী মুনীর কর্তৃক নিহত)। একমাত্র ছেলে শাফকাত নিজাম বাপ্পী। নিজাম উদ্দিন আহমদের স্ত্রী রেবা বিগত হয়েছেন ১৯৯৩ সালে।
নিজাম উদ্দিন আহমেদ বিভিন্ন প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, মিশর, ইরান, তুরষ্ক ও নেপাল সফর করেন। ১৯৭০ সালে জাতিসংঘের ২৫তম সাধারণ অধিবেশনেও তিনি যোগদান করেন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মূলত বাঙালী জাতিসত্ত্বা বিকাশের উত্থানপর্ব শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী মুসলমানেরা বুঝতে শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদেরকে নানাভাবে শোষণ-নির্যাতন করছে। ১৯৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮-র রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-র ৬ দফা ও ১১ দফা, ১৯৬৯- র গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতি যেন ক্রমশই এগিয়ে যাচ্ছিল মুক্তি-সোপানের দিকে। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তখন তুঙ্গে। এসব খবরের অধিকাংশই বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে প্রেরণ করতেন নিজাম উদ্দিন আহমদ। ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর রাজনীতির প্রতি ঝোঁক ছিল প্রবল। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিকাশের ধারাতেই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সস্পর্ক গড়ে ওঠে আওয়ামী লীগের উর্ধ্বতন নেতৃত্বের। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত রাজনৈতিক খবরই তিনি বঙ্গবন্ধুকে সরবরাহ করতেন। বঙ্গবন্ধুর খুব ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত ছিলেন নিজাম উদ্দিন আহমদ।
২৫ মার্চ কালো রাত্রির আগে চট্টগ্রামে সোয়াত জাহাজে করে যে অস্ত্র আনা হচ্ছে এই খবর তিনিই প্রথম বঙ্গবন্ধুকে প্রেরণ করেন। নিজাম উদ্দিন আহমদ এই সংবাদটি প্রথম পান ফ্রান্সের এসোসিয়েট প্রেসের (এপি) এক সহকর্মী বন্ধুর মাধ্যমে। বাঙালীর মুক্তি-সংগ্রামের একজন বলিষ্ঠ কর্মী ও সংগঠক হিসাবে গোটা পাকিস্তান আমলেই নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন তিনি।
পদ্মার কোল ঘেঁষেই ছিল নিজাম উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি। পদ্মার আলো-বাতাসেই তাঁর বেড়ে ওঠা। হয়ত এ কারণেই নিজের মনটাও ছিল পদ্মার মতোই বিশাল। বাসায় যখন থাকতেন হাসি-আনন্দে মাতিয়ে রাখতেন সারা ঘরময়। মন যখন যা চাইত, তাই করতেন। কোনো বাধা মানতেন না। কর্তব্য-কর্মে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও মুখে অনাবিল হাসি লেগেই থাকত। পেশার ব্যস্ততার কারণে পরিবারের সদস্যদের সময় দিতে পারতেন না বলে নিজে অনুতপ্ত হতেন। তবু এই সহজ-সরল মানুষটির কাছ থেকে যে স্নেহটুকু পেত পরিবারের সদস্যরা তাতেই সন্তুষ্ট থাকতেন।
নিজের গ্রাম মাওয়ার প্রতি, পদ্মা নদীর প্রতি নিজাম উদ্দিন আহমদের ছিল গভীর টান। শত ব্যস্ততার মাঝেও ছুটি নিয়ে চলে যেতেন গ্রামে। পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন পদ্মার পাড়ে। চাঁদনী রাতে পদ্মার পাড়ে পাটি বিছিয়ে স্ত্রী-সন্তান-ভাই-বোনদের নিয়ে গানের আসর জমাতেন। গানের ফাঁকে ফাঁকে নিজেই বলতেন কীর্তিনাশার কথা, পদ্মার কথা। বাড়িতে গেলেই হেঁটে হেঁটে নিজের গ্রামের লোকজনদের খবর নিতেন। সবসময় চেষ্টা করতেন লোকজনকে সহযোগিতা করতে।
বর্ষাকালে উত্তাল রূপ দেখে ঝাঁপিয়ে পড়তেন পদ্মার কোলে সাঁতার কাটতে। উন্মত্ত পদ্মায় সাঁতার কাটতে কাটতে চলে যেতেন মাঝ নদীতে। বাড়িতে খবর যেত। মা জানতেন ছেলের সাঁতারের নেশা। ছুটে আসতেন নদীর পাড়ে। ডাকতেন, 'দাদন ফিরে আয়, আর যাসনে।' দাদন, নিজাম উদ্দিন আহমদের ডাকনাম। বাবা-মা তাঁকে এই নামেই ডাকতেন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেয়ার পরপরই নিজাম উদ্দিন আহমদ বাসায় কালো পতাকা উত্তোলন করেন। এই কালো পতাকা শোষিত-নির্যাতিত মানুষের প্রতীক হয়ে উড়ছিল। পাকিস্তানের রক্তচক্ষুকে তাঁর এতটুকু ভয় ছিল না। সেসময় ঢাকায় একজন মার্কিন সাংবাদিক ছিলেন যার সঙ্গে নিজাম উদ্দিন আহমদের খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। তিনি মধ্য-মার্চে দেশ ত্যাগ করার সময় নিজাম উদ্দিনকে বিমান বন্দরে ডেকে নেন। মার্কিন সাংবাদিক তাঁকে বলেন, 'অচিরেই পূর্ব পাকিস্তানে রায়ট হবে।' নিজাম উদ্দিন আহমদ রায়ট বলতে মার্কিন সাংবাদিক ঠিক কী বুঝাতে চেয়েছেন তার মর্মপোলদ্ধি করতে পারেননি সেদিন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখন অপারেশন সার্চলাইটের নামে গণহত্যা আরম্ভ করে সেদিন রাত নয়টা পর্যন্ত তিনি নিজের অফিসেই বসে ছিলেন। আটটার দিকে হঠাত্‍ করেই ফোন করেন আওয়ামী লীগ নেতা কামরুজ্জামান। তখন পাকিস্তানী মিলিটারি জিপ রাস্তায় নেমে এসেছে। কামরুজ্জামান নিজাম উদ্দিন আহমদের কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। তিনি শুধু কামরুজ্জামানকে বলেন, 'যে যেভাবে পারেন পালিয়ে যান।' সেসময় পিপিআই অফিসে নিজাম উদ্দিন আহমদের ছোট ভাই মিনহাজ উদ্দিন আহমদও বসা ছিলেন। তিনি তাঁকে পূর্বাপর সব ঘটনা খুলে বলেন।
১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বরের সেই সকালটি ছিল অন্যদিনের তুলনায় একটু অন্যরকম। গুমট। সকাল থেকেই ঢাকার আকাশে একটা প্লেন চক্কর মারছে। বিদেশিদের উদ্ধার করার জন্যই প্লেনটা এসেছে। কিন্তু রানওয়ে খারাপ থাকার কারণে নামতে পারছে না। নিজাম উদ্দিন আহমদ সকাল থেকেই পুরান ঢাকার ১২/ সি নং রোকনপুরের বাসায় নিজের ঘরে বসে অবিরাম খবর টাইপ করে যাচ্ছেন। সর্বশেষ খবরগুলো দ্রুততার সাথে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে পাঠিয়ে দিতে হবে। টাইপ করতে করতে বারবার উঠে বাইরে দেখে আসছেন। এইভাবে একটানা দুপুর একটা পর্যন্ত কাজ করেন। চোখে-মুখে তখন ক্লান্তি আর উদ্বেগের ছাপ।
টাইপ রাইটার ছেড়ে এসে স্ত্রীকে ডেকে বললেন, 'রেবা ক্ষিদে পেয়েছে, খেতে দাও তো।' রেবা তড়িঘড়ি করে টেবিলে খাবার সাজালেন। ছেলে-মেয়ে সবাইকে ডাকলেন খাবারের জন্য। নিজাম উদ্দিন আহমদ পরিবারের সবাইকে নিয়ে খেতে ভালবাসেন। কিন্তু পেশার ব্যস্ততার কারণে সবসময় তা হয়ে উঠে না। রেবা খাবারের জন্য স্বামীকে ডাকতে গিয়ে দেখেন তিনি ঘুমোচ্ছেন। কি মনে করে আর ডাকলেন না। নিজাম উদ্দিন আহমদ একটু পরে নিজেই ঘুম থেকে উঠে একমাত্র ছেলে বাপ্পীকে নিয়ে খেতে বসেন। দুই মেয়ে সিলভী ও রীমা এল একটু পরে। নিজাম উদ্দিন আহমদ তাদেরকে বললেন, 'কী মা দেরী কেন? খেতে বস।' সেদিন খাবার টেবিলে নিজাম উদ্দিনের শ্যালক সদ্য সিএসপি অফিসার মাহাবুব কবীরও ছিলেন। তিনি শ্যালকের সাথে রসিকতা করলেন।
ঠিক সেই সময় গলির ভিতরের দরজায় শিকল ঝাঁকানোর শব্দ শোনা গেল। শব্দ শোনার সাথে সাথেই নিজাম উদ্দিন আহমদ ও পরিবারের অন্য সদস্যরা সচকিত হয়ে উঠলেন। কি ব্যাপার, কে এল? তখন সময়টাই এরকম। এতটুকু শব্দ হলেই সকলের মনে ভয় জাগে, শঙ্কা তৈরি হয়, কে এল বা কী হলো ইত্যাদি। নিজাম উদ্দিন আহমদের স্ত্রী ভাবলেন হয়ত কাজের ছেলেটা এসেছে। কিন্তু না, সাথে সাথেই কাজের মেয়েটা চিত্‍কার করে বলে উঠল, 'আম্মা মেলিটারি আইছে।' টেবিলে সকলের খাবার বন্ধ হয়ে যায়।
রেবা দৌড়ে বারান্দায় যান। গিয়ে দেখেন উঠোনে খাকি পোশাক পড়া দু'জন পাকসৈন্যের সাথে একজন বাঙালী আলবদর। তাদের একজনের চোখে সবুজ সানগ্লাস। মুখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা। উঠোনে এই দৃশ্য দেখেই রেবার বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায়। ওরা যেন সাপের মতো হিস্ হিস্ করছে। রেবা বুঝতে পারলেন না কী করবেন! স্বামীকে কোথায় লুকোবেন! পরিবারের অন্য সদস্যরা ভয়ে জড়োসড়ো, বিশেষ করে ছেলে-মেয়েরা। কিন্তু নিজাম সাহেব কোথায় লুকোবেন! পালিয়ে যাওয়ার তো কোনো পথ নেই! নিজাম উদ্দিন আহমদ পালাবার লোকও নন। সদর দরজায় পাকসৈন্য ও আলবদররা দাঁড়িয়ে আছে। রেবা যখন স্বামীকে আড়াল করতে ব্যস্ত, নিজাম উদ্দিন আহমদ কিন্তু তখন ভাবছেন কোনো অবস্থাতেই যেন ঘরের মেয়েদের ওরা কিছু করতে না পারে। তাই বাইরে থেকে পাকসৈন্যরা যখন ডাক দিল তখন নিজাম উদ্দিন আহমদ শ্যালক মাহাবুবকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। প্রথমেই ওরা নিজাম উদ্দিন আহমদের কাছে আইডেনটিটি কার্ড চাইল। তিনি কার্ড দেখান। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি নাম বলার সাথে সাথে ওরা বুকে বন্দুক ধরে বলল, 'হ্যান্ডস্ আপ'। নিজাম উদ্দিন আহমদ ওদেরকে বললেন, 'আমাকে হাত ধুয়ে আসতে দিন।' ওরা বাধা দিল।
ততক্ষণে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে কান্নার রোল শুরু হয়ে গেছে। বড় মেয়ে সিলভী 'আল্লাহ্ আল্লাহ্' করছে। হায়নার দল তাঁর বুকে বন্দুক ধরে বলল, 'আল্লাহ্ মাত্‍ বলো।' পাশে দাঁড়ানো মাহাবুবের দিকে তাকিয়ে তারা তাঁর পরিচয় জানতে চাইল। নিজাম উদ্দিন আহমদ ওদের বললেন, 'ও তো সিএসপি অফিসার।' একথা শুনে অল্প বয়স্ক ছেলেটি বলল, 'উসকো ছোড় দো।' এরপর তারা নিজাম উদ্দিন আহমদের সামনে-পিছনে দুটি রাইফেল উঁচিয়ে বাসা থেকে বের করে নিয়ে গেল। স্ত্রী রেবা পেছন পেছন দৌড়ে সদর রাস্তা পর্যন্ত যেতে চাইলেন। মাহাবুব বাধা দিলেন। তারা রাস্তায় জিপ রেখে এসেছিল। সেখানে নিয়ে নিজাম উদ্দিন আহমদকে তাঁরই গায়ের গেঞ্জি ছিঁড়ে চোখ বেঁধে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে গাড়িতে তুলে নেয়। নিজাম উদ্দিন আহমদকে সেদিন অজানার উদ্দ্যেশে নিয়ে যায় পাকবাহিনীরা।
এদিকে খাবার টেবিলে মাখানো ভাত পড়ে রইল, টাইপ রাইটারে পড়ে রইল অসমাপ্ত খবর। যে ভাতের প্লেটে, যে টাইপ রাইটারে আর কোনোদিন আঙুল বুলানোর জন্য ফিরে আসেননি নিজাম উদ্দিন আহমদ। পাক হানাদার বাহিনী নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে হত্যা করে নিভিয়ে দেয় এই আজীবন কলম সৈনিকের জীবন। নিজাম উদ্দিন আহমদের পরিবার শত খোঁজাখুজির পরও তাঁর মৃতদেহের কোনো সন্ধান করতে পারেনি।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
জন্ম : শহীদ নিজাম উদ্দিন আহমদের জন্ম ১৯২৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মুন্সিগঞ্জ জেলার মাওয়া গ্রামে। বাবা সিরাজউদ্দিন আহমদ এবং মা ফাতেমা বেগম। পিতা-মাতার চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।
শিক্ষা-দীক্ষা : লেখাপড়ার শুরু গ্রামেরই মাওয়া প্রাইমারি স্কুলে। পরে স্থানীয় কাজির পাগলা এ.টি ইনস্টিটিউশন-এ দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন। ১৯৪৬ সালে বিক্রমপুর ভাগ্যকূল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি. পাস করেন। নিজাম উদ্দিন আহমদ মুন্সিগঞ্জের সরকারি হরগঙ্গা কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট, ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্মান ডিগ্রী এবং ১৯৫২ সালে তিনি এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন।
সাংবাদিকতা : ছাত্র থাকাকালীন সময়েই নিজাম উদ্দিন আহমদ ১৯৫০ সালে করাচির 'সিভিল এন্ড মিলিটারি গেজেট' পত্রিকায় কাজ শুরু করেন। এরপর তিনি 'দৈনিক মিল্লাত', 'দৈনিক আজাদ', 'ঢাকা টাইমস', 'পাকিস্তান অবজারভার', 'এপিপি', 'এএফপি', 'রয়টার', 'ইউপিআই' ইত্যাদি পত্রিকা ও সংবাদ সংস্থায় কাজ করেন। ১৯৫৮ সালে 'এপিপি'র পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র ও প্রথম প্রতিনিধি নিযুক্ত হন। ১৯৫৯ সালে তদানীন্তন 'পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল (পিপিআই)' সংবাদ সরবরাহ সংস্থায় যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে তিনি 'পিপিআই'-এর সম্পাদক হন। ১৯৬৯ সালে থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ওই সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার হিসাবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিবিসি'র সংবাদদাতা হিসাবে কাজ করেন।
রাজনীতি : ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন সেই নির্বাচনে ১৯৬৫ সালে নিজাম উদ্দিন আহমদ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগের উর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দের অনেকের সঙ্গে তাঁর ছিল গভীর সখ্যতা।
পরিবার : নিজাম উদ্দিন আহমদ মুন্সিগঞ্জের এক রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে কহিনূর আহমদ রেবার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পত্তির তিন সন্তান। বড় মেয়ে শামানা নিজাম। মেঝ মেয়ে রীমা নিজাম। একমাত্র ছেলে শাফকাত নিজাম বাপ্পী।
মৃত্যু : ১৯৭১ সালের ১২ ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনী আলবদরদের সহায়তায় তাঁকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন