রবিবার, ১৩ জুন, ২০১০

মোবাইল সার্ভিসিং শিল্প কী সম্ভাবনাময়?

বাংলাদেশে ২ কোটিরও বেশি মানুষ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। আর সে জন্যই বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে কয়েক হাজার মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার। প্রতিটি সেন্টারে প্রতিদিন গড়ে ৮-১০টি মোবাইল ফোন মেরামতের জন্য আসে। অবস্থাভেদে সার্ভিসিং সেন্টারগুলো মাসে কমপক্ষে ৪০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা ব্যবসা করে। সে হিসেবে মোবাইল সার্ভিসিং সেক্টরের বাজার প্রায় হাজার কোটি টাকার। বাংলাদেশে মোবাইল সার্ভিসিং শিল্পের অবস্থার বর্তমান ও বিকাশ নিয়েই এই টেকজুম২৪ এর প্রতিবেদন।

বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার প্রথমদিকে শুধু ধনীদের ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে বিভিন্ন মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো কম মূল্যে সেবাদানের কারণে অতি দ্রুতহারে সবার হাতেই পৌছে যাচ্ছে মুঠো ফোন। ধনী-গরিব নিজেদের সাধ্যানুযায়ী মোবাইল সেট ব্যবহার করছে। মোবাইল ফোন সেটটি ব্যবহারজনিত বিভিন্ন কারণে কিংবা অসাবধানতাবশত নষ্ট হতে পারে। তবে এতে চিন্তার কিছু নেই। কেননা ঢাকাসহ সারা দেশে কয়েক হাজার মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। সুতরাং মোবাইল সেটের সুস্থতা নিয়ে টেনশন অনেকটাই কমে গেছে। ধীরে ধীরে মোবাইল সার্ভিসিং একটি পৃথক শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।

মোবাইল সার্ভিসিংয়ের এই বিশাল সেক্টরটির যাত্রা শুরু হয় তারুণ্যের হাত ধরে। এই শিল্পে বর্তমানে যারা দক্ষ টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করছেন তারা সবাই মূলত মোবাইল সার্ভিসিংয়ের কাজ দেখতে দেখতে শিখেছেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো যোগ্যতা না থাকলেও প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষার ওপরে ভিত্তি করে অর্জিত জ্ঞান লাভের মাধ্যমে নিজেদের দক্ষ মোবাইল সার্ভিসিং টেকনিশিয়ান হিসেবে গড়ে তুলেছেন। গত কয়েক বছরে চাহিদার কারণে এই শিল্পের বিকাশ ঘটছে দ্রুতহারে। দ্রুত বর্ধনশীল এই শিল্প মূলত শহরকেন্দ্রিক। অবশ্য বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক উপজেলাতেও এখন মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার দেখতে পাওয়া যায়। বিভাগীয় শহরগুলোতে মোবাইল বিক্রির মার্কেটগুলোকে কেন্দ্র করেই মূলত মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। এই শিল্পের প্রসারে বিশ্বাসযোগ্যতাই মূলধন হিসেবে কাজ করে থাকে। অর্থাৎ মোবাইল সেট নিখুঁতভাবে সার্ভিসিং করতে পারার মাধ্যমেই একটি মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টারের গ্রহণযোগ্যতা ব্যবহারকারীদের কাছে তাদের ব্যাপকভাবে পরিচিত করে তুলে থাকে।

ঢাকা শহরে মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার শহরজুড়ে থাকলেও মূলত ইস্টার্ন প্লাজা, নাহার প্লাজা, মোতালিব প্লাজা, বসুন্ধরা সিটি, স্টেডিয়াম মার্কেট, ফার্মগেট, পল্টন, অর্চাড পয়েন্ট, সাইন্স ল্যাবরেটরি কেন্দ্রিক শত শত মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার বেশি পরিচিতি লাভ করেছে। যে কোনো ব্র্যান্ডের যে কোনো সর্বাধুনিক মোবাইল ফোন সেটও এসব সার্ভিসিং সেন্টারে মেরামত করা হয়। বাংলাদেশে মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টারের প্রথম কেন্দ্র হিসেবে সবার আগে ইস্টার্ন প্লাজার নামই উঠে আসে। সব দিক থেকেই টেলিকম সেক্টরে ইস্টার্ন প্লাজার গুরুত্ব সর্বাধিক। মূলত প্রথম দিকে গড়ে ওঠা ইস্টার্ন প্লাজার সার্ভিসিং সেন্টারে কর্মরত টেকনিশিয়ানরাই এখন ঢাকা শহরে নিজেরা সার্ভিসিং সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়েছেন।

নিজেকে স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তোলার একটি সফল উপায় হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে সার্ভিসিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে। আর যেহেতু চাকরির বাজারে মন্দাভাব বিরাজ করছে সে জন্য অনেক শিক্ষিত ব্যক্তিও বিভিন্ন মোবাইল সার্ভিসিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ভর্তির মাধ্যমে নিজেদের দক্ষ মোবাইল টেকনিশিয়ান হিসেবে গড়ে তুলছেন। আশার কথা হলো এ সব মোবাইল ট্রেনিং ইনস্টিটিউগুলোর অনেকাংশই আইনিক। দক্ষ প্রশিক্ষক দ্বারা এ সব ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে সরাসরি ইঞ্জিনিয়ারদের মাধ্যমে হাতে-কলমে বিভিন্ন মেয়াদি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যে কেউ অল্প কিছু দিনের মধ্যে নিজেদের দক্ষ টেকশিয়ান রূপে গড়ে তোলার মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ খরচ ইনস্টিটিউট এবং প্রশিক্ষণ ভেদে আনুমানিক ৬ থেকে ২০ হাজার টাকা। এসব প্রশিক্ষণ সেন্টারে মূলত যে কোনো মোবাইলেরই হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার সংক্রান্ত সব ধরনের সমস্যা এবং সমাধানের উপায় সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ কোর্সগুলোকে শর্ট কোর্স, ডিপ্লোমা এবং হায়ার ডিপ্লোমা রূপে বিভক্ত করে একজন প্রশিক্ষণার্থীর প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। একই মোবাইলে অনেক ধরনের সমস্যা হয়ে থাকে। তবে প্রশিক্ষণ সেন্টারগুলোতে হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার দুই ধরনের প্রশিক্ষণই দেয়া হয়। কেননা ব্যবহারকারীরা হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার এই দুই ধরনের সমস্যা নিয়েই সার্ভিস সেন্টারে আসেন। তাই প্রশিক্ষণ সেন্টারগুলোও তাদের কোর্সে হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার কোর্স অন্তর্ভুক্ত রেখেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো মোবাইলে ব্লু টুথ এবং এর মাধ্যমে রিং টোন আদান প্রদান, এমপিথ্রি, ভিডিও, ইমেজ ডাউনলোড, সফটওয়্যার ইনস্টলেশন, মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার ইনস্টলেশন, মেমোরি কার্ড ডাউনলোড, মোবাইলের আনলক, ডাটাকেবল সমস্যাগুলো, হার্ডওয়্যারের ক্ষেত্রে রেজিস্টার, ক্যাপাসিটার, ডায়েড, ট্রান্সফর্মগুলো, বিভিন্ন ধরনের সার্কিট এবং সেগুলোর কানেকশন ডায়াগ্রাম, সিকিউরিটি কোডসহ বিভিন্ন ধরনের হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।

ঢাকার বিভিন্ন মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার ঘুরে জানা গেছে, প্রতিদিন অসংখ্য গ্রাহক তাদের মোবাইলজনিত সমস্যার কারণে তাদের দারস্থ হন। আর সব ধরনের সেবা প্রদানেই প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের সাহায্য করে থাকে। এ প্রসঙ্গে ইস্টার্ন প্লাজার ‘হ্যালো ফোন’-এর স্বত্বাধিকারী তমাল বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভোক্তারা সফটওয়্যারজনিত সমস্যা নিয়ে এখানে আসেন। তবে হার্ডওয়্যারের সমস্যাও কম নয়। সফটওয়্যার সংক্রান্ত বেশিরভাগ সমস্যার ক্ষেত্রে শুধু সার্ভিসিং চার্জ নেয়া হয়।

তবে হার্ডওয়্যার পরিবর্তনের জন্য সার্ভিস চার্জের পাশাপাশি পার্টসের মূল্যও পরিশোধ করতে হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে সার্ভিস চার্জ সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া গেছে তা এ রকমÑ শুধু সার্ভিস চার্জ ২০০ থেকে ৩০০, পাওয়ার না আসা ৩০০, লক খোলা ৩০০ থেকে ১০০০, ডিসপ্লে সমস্যা ৩০০, কান্ট্রিলক খোলা ৩০০ থেকে ৮০০, চার্জিং সমস্যা ৩০০ থেকে ৪০০, বাটন বা কি-প্যাড সমস্যা ২০০ থেকে ৪০০, রিংয়ের সমস্যা ৩০০ থেকে ৪০০, এন্টিভাইরাস ডাউনলোড ৩০০, প্যাকেজ ডাউনলোড ৫০০, মোবাইলের ক্যামেরা সমস্যা ১০০ থেকে ৪০০, ব্লু টুথ বা মাল্টিমিডিয়া ওপেন না হওয়া ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।
দেশের বিভিন্ন সার্ভিসিং সেন্টার ঘুরে দেখা গেছে, এই যান্ত্রিক নগর জীবনে মোবাইল সংক্রান্ত জটিলতায় ভোগা মানুষের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। গড়ে প্রতিটি সার্ভিসিং সেন্টারে এলাকা ভেদে সুনামের ওপর ভিত্তি করে ৮ থেকে ২৫ জন কাস্টমারদের সমস্যা সমাধান করে থাকে। সার্ভিস চার্জের বাইরে কাস্টমারদের খুচরা যন্ত্রাংশ কেনার জন্য অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হয়। তবে পার্টসের মতো সার্ভিস চার্জও মোবাইলে সেটটির কোম্পানিও মডেল ভেদে তারতম্য হয়ে থাকে। মোবাইলের কোনো যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে তা পরিবর্তনের জন্য পণ্যটির মূল্য মোবাইলের মডেলের সঙ্গে কমবেশি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান টেলিকম বাজারের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, পেশা হিসেবে মোবাইল টেকনিশিয়ানের পদটিকে মোটেও খারাপ করে দেখার কিছু নেই। মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টারে ৩ থেকে ১০ জন দক্ষ মোবাইল টেকনিশিয়ানের চাকরির সুযোগ রয়েছে। সে হিসেবে বাংলাদেশে দক্ষ মোবাইল টেকনিশিয়ানের যথেষ্ট চাকরির সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া মোবাইল সার্ভিসিং ট্রেনিং নিয়ে যে কেউ স্বাধীন ব্যবসা হিসেবে স্বল্প পুঁজিতে সার্ভিসিং সেন্টার স্থাপনের মাধ্যমে জীবনে সফলতা আনতে পারে। স্বাবলম্বী হতে হলে মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার স্থাপন করা সম্ভব হয় মাত্র ৫০ থেকে ১ লাখ টাকা খরচ করে। দেশের ক্রমবর্ধমান বেকার সমস্যা সমাধানে মোবাইল সার্ভিসিং শিল্পের প্রসার বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। সরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ যেমন মোবাইল ফোন সার্ভিসিং শিল্পকে আরও গতিশীল করে তুলতে পারে, ঠিক তেমনি এর মাধ্যমে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারে অসংখ্য বেকার তরুণ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন