শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১১

‘তেলের দাম, বাজারের আগুন’




 বছরের শেষভাগে এসে জ্বালানি তেলের দাম চতুর্থ দফা বাড়ানোর সরকারি সিদ্ধান্ত জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির আগুন আরো উস্কে দেবে বলেই মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।

তারা বলেছেন, তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ এবং পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এর প্রভাব অবধারিতভাবে নিত্যপণ্যের বাজারেও পড়বে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এবং বিজিএমইএ সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন মনে করেন, ভর্তুকি কমানোর জন্য তেলের দাম বাড়ানো ছাড়া সরকারের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না।

তবে বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত বলছেন, এই মুহূর্তে তেলের দাম না বাড়িয়ে অপ্রয়োজনীয় ও রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্পের খরচ কমিয়েও সরকার ব্যয় সংকোচন করতে পারতো।

বৃহস্পতিবার রাতে হঠাৎ করেই সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ৫ টাকা করে বাাড়ানোর ঘোষণা দেয় সরকার। এই নিয়ে চলতি বছরই চার দফা দাম বাড়ানো হলো।

মির্জ্জা আজিজ ও জায়েদ বখত- দুজনেই মনে করেন, সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি আরো খারাপের দিকে যাবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। গত ৯ মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘরে (ডাবল ডিজিট) অবস্থান করছে।

মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম শুক্রবার সকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তেলের দাম বাড়ানো ছাড়া সরকারের সামনে পথ ছিলো না। এর আগে দুুই দফা তেলের দাম বাড়িয়ে যে টাকা বেশি আয় হয়েছে- মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবম্যল্যায়নের ফলে তার পুরোটাই চলে গেছে ।”

এই অর্থনীতিবিদ বলেন, সরকার তেলের দাম না বাড়িয়ে ব্যাংক থেকে ধার (ঋণ) করতে পারতো। কিন্তু চলতি বছর ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ অর্থ ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল, তার প্রায় পুরোটাই সরকার ইতিমধ্যে নিয়ে ফেলেছে।

“আরও ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমে যাবে। অন্যদিকে সে ঋণের সুদ পরিশোধ করতে গিয়ে পরের বছরে বাজেটের ওপর চাপ আরও বাড়বে। এসব বিষয় বিবেচনা করে সরকার তেলের দাম বাড়ানোর পথই বেিেছে নেয়ছে।”

মির্জ্জা আজিজের ভাষায়, “সরকার আসলে তেলের দাম বাড়ানোর চক্রে পড়ে গেছে।”

অবশ্য জায়েদ বখত মনে করেন, এই মুহূর্তে তেলের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই ঠিক হয়নি।

“এমনিতেই মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপে কষ্টে আছে। এ অবস্থায় জ্বালানি তেলের দাম আরেক দফা বাড়ায় পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে মূল্যস্ফীতি আরও উস্কে যাবে।”

কেন বার বার তেলের দাম বাড়াতে হচ্ছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক বলেন, “সরকার বেশ চাপে আছে। বাজেটে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল- তার চেয়ে অনেক বেশি দিতে হচ্ছে। সে কারণে সরকারকে ব্যয় সংকোচন বা নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে।”

“তবে এই মুহূর্তে তেলের দাম না বাড়িয়ে অনুৎপাদনশীল খাত এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় নেওয়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় কমিয়েও সরকার বাজেটের চাপ কমাতো পারতো”, বলেন তিনি।

জায়েদ বখত জানান, জ্বালানি তেলের চাহিদা এক বছরে বেড়ে প্রায় দ্বিগুেেণ হয়ছে। গত অর্থবছরে যেখানে ৩৮ লাখ টন চাহিদা ছিল, এবার তা বেড়ে ৭০ লাখ টন হয়েছে। মূলত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য তেলের যোগান দিতে গিয়েই ব্যয় বেড়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম খুব একটা বাড়েনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী নিজেও উদ্বিগ্ন। তারপরও তেলের দাম বাড়িয়ে এটাকে উস্কে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না।”

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন তেলের দাাম বাড়ানোর প্রতিক্রিয়ায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এক কথা আর কতো বার বলবো। তেলের দাাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়বে। শ্রমিকদের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। পরিবহন খরচও বেড়ে যাবে। সব কিছু মিলিয়ে বাড়বে আমাাদের পণ্যের উৎপাদন খরচও।”

বর্তমান পরিস্থিতি সরকার ও ব্যবসায়ী- দুই পক্ষের জন্যই ‘দুঃসহ’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজার বিবেচনায় রেখে ভর্তুকি কমাতে হলে তেলের দাম বাড়ানো ছাড়া সরকারের উপায় নেই। কিন্তু আমাদের অবস্থাও ভালো না। ইউরোপ-আমেরিকার অর্থনীতিতে আবার মন্দা দেখা দিয়েছে। পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে মার্কেট ধরে রাখা কঠিন হবে।”

কৃষি, শিল্প ও অন্যান্য খাতের জন্য আলাদা আলাদা তেলের দাম নির্ধারণের পরামর্শ দিয়ে মহিউদ্দিন বলেন, “এ বিষয়টি নিয়ে সরকারের আরও গভীরভাবে চিন্তা করা উচিৎ বলে আমি মনে করি।”

বৃহস্পতিবার তেলের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে সরকারের এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, তেলের দাম না বাড়ালে উন্নয়ন ব্যয় কমাতে হতো। ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণও বাড়তো।

এর ব্যাখ্যায় সরকার বলেছে, এই সিদ্ধান্তের পরও ডিজেল, কেরোসিন ও ফার্নেস অয়েল বিক্রিতে সরকারকে প্রতি লিটারে ১৬ টাকা ৩৪ পয়সা, ১৪ টাকা ৮৪ পয়সা ও ৪ টাকা ৯৫ পয়সা ভর্তুকি দিতে হবে। চলতি অর্থবছরে এই খাতে সরকারকে ভর্তুকি বাবদে দিতে হবে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন