সোমবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৫

কাজল

জন্মের পরই ফেলে রেখে নিখোঁজ হয় ওর মা। অবশ্য ও কার ঔরসজাত সন্তান ছিল, আমরা তা কখনোই জানতে পারিনি। ওরও তেমন আগ্রহ ছিল না জানার। হঠাৎ একদিন রাতে দরজার কাছে কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে দরজা খুলে ওকে কোলে তুলে নেই; এরপর মা’র কোলে তুলে দিয়ে বলি দেখো কেমন ফুটফুটে আর নিষ্পাপ দেখতে। চোখের দিকে তাকালে এমন মায়া ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকায় যে, বুকের ভেতরটা কেমন নড়ে উঠে।

: কে সে হতভাগিনী মা, যে এমন সুন্দর তুলতুলে বাচ্চাটিকে ফেলে রেখে চলে গেছে! মা’র কণ্ঠে বিস্ময় ঝরে পড়ে।

: কিভাবে জানবো; হয়ত পিতৃ পরিচয় দিতে পারবে না এমন কোন মা’র ঔরসে ও জন্মেছিল বলে, অভাগী মা ওকে রাতের অন্ধকারে ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। মা আমার কিছুটা আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেন-

: মা কী করে তার সন্তানকে ফেলে চলে যেতে পারে! কিভাবে সম্ভব!

: এ পৃথিবীতে অনেক কিছুই সম্ভব হয়। কেন পত্রিকায় নিউজ পড়নি- এক মা তার ছোট্ট সন্তানকে পরকীয়া প্রেমের জের ধরে হত্যা করে ফেলে দিয়ে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল?

মা’র মুখটি বিমর্ষ দেখালে বলি, ও নিয়ে তুমি ভেবো না। দেখো বাচ্চাটা কেমন পিটপিট করে তাকাচ্ছে তোমার দিকে। এমন সময় ওর তুলতুলে কচি একটা হাত বাড়িয়ে মা’র মুখের কাছটা তে নিয়ে খামচে ধরতে চায়। মা আমার মাতৃত্বের স্বভাবসুলভ ভঙ্গি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলে- ও লে লে বাবুটা তোর খিদে পেয়েছে বুঝি? আমি অবাক হই ওর কাণ্ড দেখে! মা’র কণ্ঠ শুনতেই ও কেঁদে ওঠে, যেন বলতে চায় এই যে আমার খুব খিদে পেয়েছে, সারাদিন কিছু খাওয়া হইনি। এক্ষুণি আমাকে দুধ দাও! মা ওকে আমার কোলে দিয়ে বলেন, একটু ধর তো খোকা, ওর জন্য একটু দুধ করে আনি। আমি কোলে তুলে নিয়েই ওর সঙ্গে খানিকটা দুষ্টুমিতে মেতে উঠি। একটু পর মা বোতলে দুধ নিয়ে এসে ওর মুখে ধরতেই চুকচুক শব্দ করে খেতে শুরু করে। কি সুন্দর কাজল টানা চোখ! মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে মাকে বলি ওর একটা নাম রাখা উচিত। মা আমার মুখের দিকে জিজ্ঞাসার দৃষ্টি মেলে বলেন-

: তাইতো, ওকে আমরা কী নামে ডাকবো খোকা?

: দেখো কী সুন্দর ওর চোখ দু’টি! ওকে আমরা কাজল ডাকবো। মা’র চোখের দিকে তাকাতেই সম্মতি দিয়ে বলেন ঠিক আছে ওর নাম আজ থেকে তাহলে কাজল। অবশ্য ভাইয়া, বাবা, ছোট বোন ওদেরও কারও কোন আপত্তি ছিল না তাতে। সেদিন থেকে ও আমাদের পরিবারের একজন সদস্য হয়ে যায়।

আমাদের কথোপকথনের মাঝে কাজল দুধ শেষ করতে না করতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে। মা ওকে পরিষ্কার কাপড়ে মুড়িয়ে বিছানার এক পাশে শুইয়ে দেয়। রাত অনেক হয়েছে এবার ঘুমিয়ে পড় সবাই, বলে নিজের রুমে চলে এসে বিছানা পত্র ঠিকঠাক করে নিয়ে শুয়ে পড়ি কিন্তু ঘুম আসে না। কাজলের মায়া ভরা মুখটা ভেসে ওঠে, কী নরম আর তুলতুলে শরীর। ওর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ি তা মনে পড়ে না।

দেখতে দেখতে কাজলটা কেমন বড় উঠতে শুরু করে। হা পা শক্ত হয়েছে বেশ। এ ঘর থেকে ও ঘরে চোখের পলকেই কেমন ছুটোছুটি করে বেড়ায়। একদম ভয় পায় না কিছুতেই। যে ঘরেই থাকুক না কেন, মা রান্না ঘরে বসে ডাকতেই ছুটে যায় মুহূর্তে। যেয়ে এমন ভঙ্গি করে মা’র দিকে তাকায় যেন বলতে চায়- কী হয়েছে? আমাকে ডাকছ কেন? মা বলেন নে দুধ খা, খিদে পায়নি বুঝি তোর? ও মোচড়াতে মোচড়াতে ধীরে ধীরে মা’র কোলের কাছে যায়, তারপর মাথা দিয়ে ঘষতে শুরু করে দেয়। ও যে নিজে খাবে না তা আর তার বুঝতে অসুবিধে হয় না, মাও বাটিতে দুধ ঢেলে চামচে তুলে ওর মুখের কাছে তুলে ধরতেই চুকচুক শব্দ করে খেতে শুরু করে। পুরোটা শেষ করে না, বাটিতে অল্প অবশিষ্ট থাকতেই খাওয়া ফেলে রেখে দৌড়ে চলে আসে রান্না ঘর থেকে, এরপর এ ঘর ও ঘরে ছুটে বেড়ায়। মা ওকে একটু ডেকেই আবার রান্নায় মনযোগী হয়।

এভাবে কয়েক দিন পেরিয়ে যায়। এক সময় কাজল শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রাখে। হঠাৎ একদিন দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক উৎসুক দৃষ্টি মেলে দেয়। মা ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়াতেই তার দিকে মুখ তুলে এমন ভাবে তাকায়; যেন বলতে চায় আমি বড় হয়ে গেছি, আমাকে বাইরে যেতে দিতে হবে এখন থেকে। মা ওকে বলে ঠিক আছে যাবি, তবে খুব বেশি দূরে যাবি না, এদিক ওদিক একটু ঘুরে ফিরে চলে আসবি তাড়াতাড়ি। মা’র অনুমতি পেতেই ছুটে বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে অথচ একটু পরই ফিরে এসে দৌড়ে চলে যায় রান্না ঘরের দিকে। যেন ঠিক ওর জানা আছে মা এ মুহূর্তে সেখানেই আছেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন কিরে চলে এলি যে? ও বলে ভয় লাগে, সবাই কেমন হা করে তাকিয়ে থাকে। মা হাসতে হাসতে কোলে তুলে নেয় ওকে।

একদিন ওর চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে যাই টয়লেটের কাছে। গিয়েই সবাই হাসিতে ফেটে পড়ি! আমাদের দেখাদেখি সেও টয়লেট করতে গিয়ে কমোডে পড়ে গিয়েছিল সেদিন। হাসি থামিয়ে মা ওকে তুলে নিয়ে ভাল করে গোসল করিয়ে দিয়ে বলেন- তোর এখনও কমোডে বসে টয়লেট করার বয়স হয় নি রে। তারপর টয়লেটের মেঝের পানি যাওয়ার ছিদ্র দেখিয়ে বলেন তোর যদি টয়লেটে যেতে ইচ্ছে করে তাহলে এখানে বসে করবি। ও বিনা প্রতিবাদে মা’র আদেশ মেনে নিয়ে ছিল। এরপর থেকে টয়লেট চাপলে মা’র দেখানো স্থানে কাজে সেরে নিত।

এভাবে আমাদের পরিবারে কাজলের হাসি আনন্দে দিন গুলো কেটে যেতে থাকে। দিনে দিনে ও আমাদের সবার মনে খুব গভীর ভাবে স্থান করে নিতে শুরু করে। দুপুরে যখন খেয়ে শুতে যেতাম সেও আমাদের সাথে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়তো। খুব একটা বাইরে বেরুত না কিন্তু যখন কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্য তারপর একদিন যৌবনে পা রাখল হঠাৎ করেই অনুভব করলো ওর একজন সঙ্গিনী প্রয়োজন। বয়স তো আর কম হল না! এবার একজন সঙ্গিনী না হলেই যে নয়! এরপর থেকে ও প্রতিদিন বেরিয়ে পড়তো এবং যৌবনের সে দিন গুলোতে ভালবাসা ভাব বিনিময়ের জন্য সঙ্গিনী খুঁজতে লাগলো। পেয়েও যায়। প্রতিদিন নিয়ম করে তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে, দিবসের খানিকটা সময় সঙ্গিনীর সাথে কাটিয়ে ফিরে আসতো গৃহে। আমরা কেউ ওকে বাঁধা দিতাম না। কেননা আমাদের ধারণা ছিল যৌবনে ও যাকে সঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিয়েছে তা ওর সঠিক সিদ্ধান্তই ছিল।

সময়ের অমোঘ নিয়মে সন্তান বড় হলে বিয়ে হয়, ঘর সংসার হয়। আলাদা বসতি গড়ার স্বপ্ন তৈরি হয়। ওর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। জীবন সঙ্গিনী বেছে নেয়ার পর একদিন হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নিলো আলাদা থাকবে। আমাদের অবশ্য ওর সিদ্ধান্তে কোন আপত্তি ছিল না। কেননা ওর প্রতি আমাদের ভালবাসা এবং আস্থার কারণে আমরা জানতাম ও কখনও আমাদের ছেড়ে থাকবে না। রোজ সকাল বিকাল এসে খানিকটা সময় কাটিয়ে ফিরে যেত ওর নূতন বাসস্থানে। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন গুলো। ওর সংসারে নূতন অতিথি এলো। ব্যস্ততা বেড়ে গেল। আসা যাওয়াটাও কিছুটা কমতে শুরু করে কিন্তু আমরা কখনও ওকে ভুল বুঝিনি। সময় মানুষকে ইচ্ছে সত্ত্বেও অনেক কিছু করতে দেয় না। ওর ক্ষেত্রেও তেমনটা হলেও আন্তরিকতার কমতি ছিল না কখনও। সময় পেলেই চলে আসতো। এভাবে চলে যায় বেশ কিছু কাল। ধীরে ধীরে কাজল যৌবন পেরিয়ে একদিন বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হল। ওর সারা গায়ে তার ছাপ গুলো স্পষ্ট হতে থাকে। আগের মত আর চলতে ফিরতে পারতো না, সে কারণে যাওয়া আসাটা কমতে লাগলো। এভাবে কমতে কমতে তা এক সময় প্রায় শূন্যের কোঠায় এসে উপনীত হল। এখন কাজল মাঝে মধ্যে আসে অল্প সময়ের জন্য। এভাবে বেশ কিছু কাল অতিক্রম হওয়ার পর হঠাৎ প্রায় আসা বন্ধ হয়ে যায়। বেশ কয়েক দিন খোঁজ পাই না আর। সবাই ওর জন্য উদ্বিগ্ন হই, তাকিয়ে থাকি ওর আসার পথে। না ও আর আসে না। মা বিষণ্ণ মুখে বলেন দেখ না খোকা একটু খোঁজ নিয়ে। আমি এ পাড়া ও পাড়া অলিগলি তন্নতন্ন করে খুঁজে ফিরে আসি, না ওকে কোথাও আর দেখা যায় না।

একদিন রাত প্রায় বারটা হবে। হঠাৎ দরজার কাছে কারও কান্নার শব্দ পেয়ে বুকটা ধক করে উঠে। বিছানা থেকে এক রকম লাফিয়ে চলে আসি দরজার কাছে। দরজা খুলতেই দেখি আমাদের কাজল, বয়োবৃদ্ধ কাজল। শরীরে অসংখ্য ক্ষতচিহ্নের সাথে কাদা মাখানো। ক্ষতচিহ্ন থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কাজলকে ভীষণ ক্লান্ত দেখায়। যেন জীবনের এই সায়াহ্নে এসে ও পুরোপুরি বিধ্বস্ত অসহায়! ও মুখ তুলে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে; সঙ্গে সঙ্গে ওকে কোলে তুলে নিয়ে মাকে ডাকতে শুরু করি। মা ওকে দেখেই কোলে তুলে নিলে তার মুখটা তখন বেশ মলিন মলিন লাগে। মা ওকে খুব যত্ন করে গোসল করিয়ে ক্ষতস্থানে ঔষধ লাগিয়ে পরিষ্কার কাপড়ে মুড়ে বিছানার এক পাশে শুইয়ে দেয়। মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা। প্রথম যেদিন এই একই ভাবে ওকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম। সে রাতে আমাদের আর খাওয়া হয় না। অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা আমাদের সবাইকে গ্রাস করে নেয় যেন। আমাদের সংশয় তৈরি হয়ে এই ভেবে কাজল আর বাঁচবে না হয়ত! ওকে ঘিরে কিছু সময় আমরা বসে অতীত চারণ করতে থাকি এবং এক সময় সবার চোখে ক্লান্তি নেমে এলে যার যার রুমে ফিরে এসে শুয়ে পড়ি।

রাত পেরিয়ে ভোর হয়। প্রতিদিনের মত সবাই জেগেও উঠি। কিন্তু কাজল তখনও ঘুমিয়ে, কী এক আশ্চর্য রকমের প্রশান্তি চোখে মুখে নিয়ে ও তখনও ঘুমিয়ে। না, ঘুম আর ভাঙ্গে না। ওর কাজল টানা চোখ যেন আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে আর আমাদের চোখের কোনে বিন্দুর মতো ক’ফোঁটা জল চিকচিক করতে থাকে। আমাদের সেই ছোট্ট বিড়াল ছানা কাজল সেদিনের পর আর ঘুম থেকে জেগে ওঠেনি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন