সোমবার, ৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আইসক্রিম (২০১৬)

চলচ্চিত্রের নামঃ আইসক্রিম (২০১৬)
মুক্তিঃ ২৯শে এপ্রিল, ২০১৬
অভিনয়ঃ উদয়, রাজ, তুষি, ওমর সানী, দিতি এবং এটিএম শামসুজ্জামান
কাহিনী ও পরিচালনাঃ রেদওয়ান রনি
প্রযোজনাঃ টপ অব মাইন্ড, পপর্কন ফিল্মস, পিং পং এন্টারটেইনমেন্ট
কাহিনী সংক্ষেপঃ ছবির গল্প ঢাকার তিন তরুন, তরুনীকে নিয়ে। গল্পটা আজকের যূগের তরুন, তরুনীদের প্রেম ভালোবাসা নিয়ে যে সমস্যা বা মনস্তাত্বিক দ্বন্দ তার একটা দার্শনিক সমাধান দেখায়। গল্পটি সহজ, তবে অসাধারন তার উপস্থাপন। চলচ্চিত্র বিষয়টিই এমন যে সহজ, সাধারণ এবং পরিচিত গল্পই সুন্দর ন্যারেটিভ স্টাইল বা উপস্থাপনে অসাধারন হয়ে উঠে। এ ছবিতে ফুলের টবে গাছ, সে টবে আগাছার বেড়ে ওঠা এবং এক সময় সেই আগাছাই মূল গাছটিকে গ্রাস করার যে ন্যারেটিভ স্টাইল তা বাংলা চলচ্চিত্রে আমার দেখা সেরা ন্যারেটিভ স্টাইলের একটি। ছবির চিত্রনাট্যটি এতোটাই স্মার্ট এবং পরিচ্ছন্ন যে পুরো ছবির প্রতিটা দৃশ্য মুগ্ধ করে দেয়। একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চিত্রনাট্যের কোথাও বোর হওয়ার সূযোগ নেই। একটি সাধারন কাহিনী কিংবা সহজ কিছু ঘটনা যখন চিত্রনাট্যে মজাদার হয়ে উঠে চিত্রনাট্যকার তখন শতভাগ সাফল্য দাবী করতেই পারেন।

অভিনয়ঃ নাজিফা তুশি ছবির প্রান। সে দেখতে যেমন সুন্দর, অভিনয়েও তেমনি সাবলীল। এতো সাবলীল অভিনয় এ সময়ের খুব কম অভিনেত্রীদের দ্বারাই আশা করা যায়। উদয়ও খারাপ করেনি। আর এক ভবঘুরে, ফ্লর্ট শহুরে তরুনের চরিত্রে রাজ অত্যন্ত উপভোগ্য পারফর্মেন্স দেখিয়েছে। ব্যাক্তিগতভাবে রাজের চরিত্র এবং অভিনয় আমার সবচেয়ে বেশী ভালো লেগেছে। অন্য যারা ছিলো যেমন এটিএম সামসুজ্জামান, সায়েম সাদাত, বিদেশী মেয়েটি; সবাই ভালো করেছেন। তবে নাদিমের এক্স গার্লফ্রেন্ড, জয়িতা চরিত্রের মেয়েটি এক কথায় অসাধারন ছিলো। তার চরিত্র এবং অভিনয় দুটোই বিশেষ ভালো লাগার তৈরী করেছে।


লিড কাস্টে ছিল নতুন তিনজন অ্যাক্টর অ্যাক্ট্রেস, কিন্তু একটা বারের জন্যও এদের নতুন মনে হয়নি। অনেকদিন পর বাংলা চলচ্চিত্র ভাল একজন অভিনেত্রী পেল, নাজিফা মেয়েটা খুবই ভাল পারফর্ম করেছে। আর হিরো দুইজন থাকায় মনে হলো হিরোদের জন্যেই সুবিধা হয়েছে। একজন আরেকজনের সাথে পাল্লা দিয়ে পারফর্ম করেছে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে ঠান্ডা শান্ত ক্যারেক্টারের উদয়কে সব দর্শকের ভাল্লাগবে, কিন্তু আমার পারসোনালি ভিলেন পছন্দ বলে রাজকে হয়তো বেশি ভাল লেগেছে। প্লে বয় ক্যারেক্টারে ফাটিয়ে অভিনয় করেছে ছেলেটা। নতুন তিনজনই অনেক ভাল করেছে। সবচেয়ে ভাল লেগেছে নতুন বলে এদের কথা বলায় কোন রকম জড়তা ছিলই না, বরং তিনজনেরই ভয়েস ডেলিভারি ছিল প্রধান প্লাস পয়েন্ট।
পরিচালনাঃ পরিচালক হিসেবে রেদোয়ান রনি বেশ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। ২ ঘন্টায় একটি গল্প এবং তিনটি চরিত্রকে এতোটা গোছানো এবং উপভোগ্য করে পর্দায় নিয়ে আসার জন্য পরিচালক এবং সম্পাদক প্রশংসা পওয়ার যোগ্য বলতে হবে। ছবির সংলাপ অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এবং মজাদার। কিছু সংলাপ হাস্যরস তৈরী করে তো কিছু সংলাপ হৃদয়কে স্পর্শ করে। এতোটা উপভোগ্য সংলাপ বাংলা সিনেমায় সব সময় পাওয়া যায় না। রোমান্টিক ছবি হিসেবে অযাচিত গান ছবিতে নেই। যা কিছু গান আছে তা ছবিকে সুন্দরভাবে ন্যারেট করার জন্য। কোন ধরনের অপ্রয়োজনীয় গান বা দৃশ্য জুড়ে না দিয়ে মুভিটাকে ২ ঘন্টার মাঝে রেখেছেন এজন্য সাধুবাদ পাবেন।
নির্মাণে যে এলিমেন্টগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো স্মার্ট ছিল। ব্যবহারটাও স্মার্টলি হয়েছে। যে জেনারেশনের গল্প ঠিক সেই গল্পের মত করে ‘আইসক্রিমের’ মেকিং মানানসই। এটা হয়তো আপনার গল্প নাও হতে পারে কিন্তু যেকোন গল্পই যে নির্মাণ ডিসার্ভ করে সেই ফরমেটে নির্মিত হলে- তা সবারই ভাল লাগে। এটাই সিনেমার স্মার্টনেস। আইসক্রিম সেই অর্থে সত্যিকারের স্মার্ট সিনেমা।

চিত্রনাট্য ও সিনেমাটোগ্রাফীঃ ছবির লোকেশন এবং সিনেমাটোগ্রাফী এতোটাই সুন্দর যে প্রতিটি শট মুগ্ধ হওয়ার মতো। বিশেষ করে সেন্টমার্টিনের দৃশ্য, লঞ্চ ভ্রমনের দৃশ্য, নদীতে অতিথি পাখির ডানা ঝাপটানো কিংবা মুষলধারার বৃষ্টিতে গাড়ীর মধ্যে রোমাঞ্চ; প্রত্যেকটি দৃশ্যই চোখ এবং মন দুটোকেই তৃপ্তি দেয়। ঢাকা শহর কিংবা বাংলাদেশ অত্যন্ত সুন্দরভাবে এ ছবিতে ধরা দিয়েছে। স্মার্ট স্ক্রিপ্ট এবং ডিরেকশনের জন্য সেটা অনেকাংশে উতরে গেছে। চোখের জন্য ক্যামেরার কাজগুলো বেশ আরামদায়ক ছিলো। ছিমছাম আর ঝকঝকে।
গল্পে সুন্দর একটা গতি আছে। ছবির প্রথম ১৫ মিনিটে হয়তো একটু হতাশ হলেও গল্পের তরতর করে এগোনো সেই হতাশা দূর করে দর্শককে ধরে রাখবে। আর তৃতীয় চরিত্র- নাদিমের আসার পরে গল্পকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। আর ভাল সিনেমার একটা কমন সূত্র হচ্ছে – প্রথমার্ধের চেয়ে দ্বিতীয়ার্ধ ভাল হতেই হবে। ‘আইসক্রিমে’ তা আছে। শেষ ২০ মিনিট তো অসাধারণ যেটা দর্শকের মাথায় রয়ে যাবে সিনেমা শেষ হবার পরেও।
উপসংহারঃ সবমিলিয়ে, রেদোয়ান রনির আইসক্রিম একটি সুনির্মিত, সুন্দর এবং সুমিষ্ট বাংলাদেশী চলচ্চিত্র। এরকম উপভোগ্য চলচ্চিত্র কালে ভদ্রেই আসে। নির্মাতা রোমান্টিক চলচ্চিত্রে নির্মানে যে স্টাইল, যে রুচী, যে সৌন্দর্য, যে পারফেকশন দেখিয়েছেন তার জন্য বাংলা চলচ্চিত্রপ্রেমী হিসেবে তাকে মন থেকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তার কাছ থেকে আরো ভালো ভালো ছবির প্রত্যাশা রইলো। আইসক্রিম সূপারহীট হবেই। এর ওয়ার্ড অব মাউথ এতোটাই ভালো যে মোল্লা বাড়ীর বউ এবং মনপুরার পর কোন ছবি দেখে দর্শকদেরকে এতোটা মুগ্ধ হতে দেখেছি । সূতারং যারা এখনো ছবিটি দেখেননি তারা বন্ধু বান্ধব নিয়ে হলে গিয়ে ছবিটি উপভোগ করতে পারেন। বন্ধু বান্ধব কিংবা ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে হলে ছবি দেখতে চাইলে আইসক্রিম এর চেয়ে সুস্বাদু কিছু এই মূহুর্তে আর দ্বিতীয়টি নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন