শনিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১১

নজরুলের হারিয়ে যাওয়া গান “ওরে আশ্রয়হীন শান্তিবিহীন আছে তোরও ঠাঁই আছে…”

nazrul_babu.jpg

নজরুল রচনার কিয়দংশ এখনো অনাবিষ্কৃত। ১৯৪২ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তাঁর সৃষ্টির নানা দিক প্রকাশিত হয়। এরপর তা দুষ্প্রাপ্যের খাতায় নাম লেখায়। নজরুলের অবমূল্যায়ন, সাতচল্লিশের দেশবিভাগ নজরুল শিল্পী, গবেষক ও সাহিত্যিকদের হতাশ করে তুলেছিল। কবিবন্ধু কমরেড মুজফ্‌ফর আহমদ এককভাবে নজরুলচর্চা শুরু করেন। বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, কমল দাশগুপ্ত প্রমুখ ষাটের দশকের প্রথম দিকে নব উদ্যমে কাজ শুরু করেন নজরুল নিয়ে। নবজাতক প্রকাশনীর মাজহারুল ইসলাম, কবি জিয়াদ আলী, নজরুলের আত্মীয় কাজী আব্দুল সালাম এ প্রচেষ্টায় শরীক হন। ঢাকাতে নজরুল একাডেমি প্রাতিষ্ঠানিক কাজ শুরু করে। কবি আবদুল কাদির, খান মুহম্মদ মঈনুদ্দীনসহ অনেকেই ঢাকায় নতুন করে নজরুলচর্চায় নিয়োজিত হন। তাতে কবির ছড়িয়ে থাকা হারিয়ে যাওয়া অনেক কবিতা, গান, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, নাটক, চলচ্চিত্র, রেকর্ড আবিষ্কৃত হতে থাকে। সেলিনা বাহার জামান, সঙ্গীতজ্ঞ আব্দুস সাত্তার, সঙ্গীতজ্ঞ মফিজুল ইসলাম, কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ কবির হারানো সম্পদ পুনরুদ্ধারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।


দুই.
আমি নজরুলের ওপর কাজ করছি দীর্ঘ দিন ধরে। কাজ করতে গিয়ে অনেক নতুন জিনিস পাচ্ছি, তখন আনন্দে উদ্বেলিত হচ্ছি। তো সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগরে আমার এক ছাত্র নির্ঝর অধিকারী সংবাদ দিলো যে পাবনায় একটি নাটক খুঁজে পাওয়া গেছে ১৯৪০ সালে প্রকাশিত, যেখানে নজরুলের কিছু গান আছে। প্রথমে আমি বিষয়টি পাত্তা দেই নি। তারপরে যে ভদ্রলোকের কাছে এই নাটকের বইটি ছিল, তাঁর সঙ্গে আমি মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করি। তখন ওই ভদ্রলোককে—তাঁর নাম আবুল কাশেম, তিনি সংগীত শিল্পী—আমি বলি যে, আপনি নাটকটি পাঠিয়ে দিন ফটোকপি করে। উনি বললেন, বইটি বেশ পুরোনো, পাঠানো যাবে কিনা সন্দেহ আছে, আমি গান কয়টি পাঠিয়ে দিচ্ছি আগে।
যাই হোক পরে আমি বইটি পেয়ে গেলাম। নাটকের নাম বিদ্রোহী বাঙ্গালী। রচয়িতা শ্রীযুক্ত রমেশ গোস্বামী। পাবনার সপ্তর্ষী পাঠাগারে এটি রক্ষিত ছিল। বইয়ের মূল মালিক সম্ভবত মহব্বত আলী মিঞা। অন্তত বইয়ের প্রথম পাতায় ‘মহব্বত আলী মিঞা’ সই থেকে সেরকম ধারণা হয়।
বই পেয়ে খুঁজতে শুরু করলাম যে কতগুলো গান আছে। দেখলাম ছয়টি গান আছে এবং ছয়টি গানের একটি-দুটি গানের প্রথম লাইন আমার কাছে পরিচিতই মনে হলো। কিন্তু বাকি গানগুলো অপরিচিত এবং মনে হলো যেন আগে গাওয়া হয়নি। আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্য নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে প্রকাশিত রশিদুন্ নবীর নজরুল সঙ্গীত সমগ্র (২০০৬) সংকলনটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে শুরু করলাম। মিলিয়ে দেখতে গিয়ে দেখি যে সেখানে পাঁচটি গানের উদ্ধৃতি পাওয়া যায়। বাকি একটির কোনো উল্লেখ নেই।
তিন.
নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ নজরুল সঙ্গীত সমগ্র একটি নির্ভরযোগ্য সংকলন। সংগ্রাহক ও সম্পাদক রশিদুন্ নবী বিভিন্ন সূত্র থেকে নজরুলের গানগুলি সংগ্রহ করেছেন। বইয়ের সম্পাদকীয় অংশে তিনি এইসব গানের উৎস গ্রন্থের একটি তালিকা দিয়েছেন। সম্পাদকীয় অংশে তিনি বলছেন, “এই সংকলনের সূচিপত্রে কাজী নজরুল ইসলামের ৩১৬৩টি গানের প্রথম পঙ্‌ক্তির উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে ৩০৭৯টি গানের বাণী দেওয়া সম্ভব হয়েছে। অবশিষ্ট ৮৪টি গান উদ্ধার বা সংগৃহীত না হওয়ায় সেগুলির বাণী দেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে এত অধিক সংখ্যক নজরুল সঙ্গীতের বাণী সম্বলিত সংকলন ইতঃপূর্বে কোথায়ও প্রকাশিত হয়নি।” তো রশিদুন্ নবীকৃত এই বাণী সংকলনে যেহেতু এই গানটি নেই তদুপরি অবশিষ্ট ৮৪ সংখ্যক অ-বাণী প্রথম পঙ্‌ক্তি তালিকায়ও এর প্রথম পঙ্‌ক্তি নেই, বলা যায় এটি গবেষক-সংগ্রাহক-গায়ক-সুরকারদের চোখের আড়ালে থেকে যাওয়া একটি গান। এই গান ইঙ্গিত করে নজরুলের এমন আরো অনেক গান নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও রয়ে গেছে লোকচক্ষুর আড়ালে।
চার.
babu_22.jpg……
বিদ্রোহী বাঙ্গালীর প্রথম পৃষ্ঠা
…….
আবিষ্কৃত এই গানটি এত গুরুত্বপূর্ণ যে এই গানটি দিয়ে একটি দৃশ্য রচনা করা হয়েছে। চতুর্থ অংকের ২য় দৃশ্য এটি, এবং এই গানের পরে ৩য় দৃশ্য শুরু হয়েছে; এবং আগে প্রথম দৃশ্য শেষ হয়ে গেছে, তার মানে গানটির গুরুত্ব অপরিসীম। আজকে নজরুলের এই শুভ জন্মদিনে আমি নজরুল প্রেমিক তথা সমগ্র বাঙালীর কাছে এই গানটি তুলে ধরতে পারছি। অনেক বড় রচনার ভেতরে এটা হয়তো খুবই ক্ষুদ্র একটা জিনিস, তবুও এই গানটি আমি মনে করি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সে জন্য এই গানটি পাঠক শ্রোতার জন্য আমার নিবেদন।
অনেকে হয়তো ভাবতে পারেন যে নজরুলের গান—আপনি সুর কোথায় পেলেন! তো দীর্ঘদিন যাবৎ নজরুলের উপরে… জগৎ ঘটক, নিতাই ঘটক, কমল দাশ গুপ্ত, মফিজুল ইসলাম, সন্তোষ সেন গুপ্ত থেকে শুরু করে অনেকেই নজরুলের গান সুর করেছেন এবং সেগুলো খুব জনপ্রিয় হয়েছে। নজরুলের ভাব এবং নজরুলের স্কুলে যদি সুরটা পড়ে তাহলে সেই গানটা জনপ্রিয় হবে। আর যখনই তার মতো হবে না তখন সেটা হারিয়ে যাবে। তো আমি ইতিমধ্যে কয়েকটি গান সুর করেছি, এই গানটিও আমার সুর করা। গানটি আমি খাম্বাজ, ঝিঁঝটি, দেশ তিনটি রাগের সংমিশ্রণে করেছি। নাটকে একটি গ্রামীণ বাউল ফকির গানটি গাইতে গাইতে যায়… যখন বাঙালীদের অবস্থা করুণ; মোগলরা বাঙালীদের ওপর অত্যাচার করছে। সেই সময় একটি চরিত্রের যে অসহায় অবস্থা তা বর্ণনা করা হয়েছে এ গানে।
পাঁচ
babu_21.jpg……
বইয়ে প্রকাশিত ‘নাটক সংগঠন কারীগণ’-এর তালিকা
……
নাটকটির নিবেদন অংশে রমেশ গোস্বামী লিখেছেন, “আমার নাটকের গান লিখিয়া দিয়াছেন বাঙ্গলার বিদ্রোহী কবি ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ এবং গ্রন্থ প্রণয়নে আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করিয়াছেন বন্ধুবর শ্রীযুক্ত শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। তাহাদের উভয়ের নিকট আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞ।”
বইয়ে ঠিকানা উল্লেখিত হয়েছে ৫, নন্দলাল বসু লেন, বাগবাজার, কলিকাতা। তারিখ, মহাসপ্তমী, ২১শে আশ্বিন, ১৩৪৭ সাল। প্রকাশকের নাম এসেছে, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স্; ২০৩/১/১ কর্ণওয়ালিশ ষ্ট্রীট্, কলিকাতা।
উল্লেখ্য, কলিকাতার নাট্যনিকেতনে নাটকের প্রথম অভিনয় রজনী ছিল মহাসপ্তমী ২১ শে আশ্বিন ১৩৪৭ (১৯৪০)। নাটক পরিচালনা করেন সতু সেন। প্রযোজনায় ছিলেন সুধীর গুহ; নৃত্য-পরিকল্পনায় শ্রীমতি নীহার বালা; সঙ্গীত পরিচালনায় ফনী শীল; স্মারক পাঁচকড়ি সান্ন্যাল; বেহালাবাদক তারক চ্যাটার্জী; বংশীবাদনে কালোবাবু; আহার্য্য সংগ্রাহক ছিলেন সত্য মুখার্জ্জী আর গান ও সুর-এর দায়িত্বে কাজী নজরুল ইসলাম।
ছয়.
নাটকে গানের ধারাক্রম ছিল এরকম:
প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে সেবিকার ভূমিকায় চিন্ময়ীর কণ্ঠে গান ‘দীনের হতে দীন দুখি অধম যেথায় থাকে’ গীত হয় (পৃ. ২)। প্রথম অংকের ৩য় দৃশ্যে ছিল নর্তকীদের গান ‘কেন চঞ্চল অঞ্চল দুলিয়া ওঠে’(পৃ. ২৪)। একই দৃশ্যে মেহেরার কণ্ঠে ছিল গজল ‘গুলাব গুলের পিয়ালাতে’ (পৃ. ৩০)। উল্লেখ্য নাটকে মেহেরা আগ্রার নর্তকী, চিন্ময়ী মন্দিরের সেবিকা। এই দৃশ্যে মেহেরার আর একটি গান ‘আশা নিরাশায় দিন কেটে যায়’ গীত হয় (পৃ. ৭৬)। এই অংকের পঞ্চম দৃশ্যে চিন্ময়ী গেয়ে ওঠে ‘নিপীড়িতা পৃথিবী ডাকে’ (পৃ. ৯৬)।
চতুর্থ অংকের দ্বিতীয় দৃশ্যের শেষ গানটিই আমাদের এই গান। এটি গেয়েছিলেন এক উদাসী গ্রামীণ ফকির বা বাউল। (পৃ. ১০৬/১০৭)। উল্লেখ্য যে চতুর্থ অংকের প্রথম দৃশ্য ও তৃতীয় দৃশ্যের মাঝে দ্বিতীয় দৃশ্যে কোনো সংলাপ নেই; আছে শুধু এই গানটি। গানটির বক্তব্যই ঐ দৃশ্যের মূল কথা।
নাটকটি নিয়ে কোথাও তেমন তথ্য নেই। পশ্চিমবঙ্গের গবেষক ব্রহ্মমোহন ঠাকুরের নজরুল নাট্য গবেষণা বইয়ে নাটকের উল্লেখটুকু শুধু আছে। বিস্তারিত কিছু নেই।
সাত.
গানটি:
ওরে আশ্রয়হীন শান্তিবিহীন
আছে তোরও ঠাঁই আছে।
সকলেরে যিনি আশ্রয় দেন
তার চরণের কাছে॥ তোর যেখানে যা কিছু আশ্রয় ছিল
যে নিঠুর নিজে এসে ভেঙে দিল
সেই তোর তরে নিত্য পরম
আশ্রয় রচিয়াছে ॥
তাঁর ললাটের আগুনের দাহ
দেখেছিস তুই যবে
নামিবে এবার করুণ গঙ্গা
অমৃতে পূর্ণ হবে ॥
(জীবন অমৃতে পূর্ণ হবে।)
তুই নির্মল হলি আগুনে পুড়িয়া
এইবার চল জুড়াইতে হিয়া
ওরে মরণের মাঝে দেখরে পরম
অমৃতময় নাচে ॥
(যার চরণে মরণ লভেছে মরণ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন