সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

আ ন ম গোলাম মোস্তফা

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের দুই কি তিন তারিখের ঘটনা। মোস্তফা তাঁর শ্বশুরবাড়ি রায়ের বাজার গিয়েছিলেন সম্বন্ধীর বৌভাত খেতে। মোস্তফার স্ত্রী-সন্তানও সেখানে ছিলেন। সকাল বেলা সবাই মিলে বারান্দায় বসে রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনছেন। এমন সময় পাকসৈন্য ও রাজাকাররা হঠাত্‍ করে পুরো বাড়িটি ঘিরে ফেলে। সাথে সাথেই রেডিওর নব ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। রাজাকাররা বাড়ির ভেতরে ঢুকেই রেডিওতে পাকিস্তানের চ্যানেল শুনতে পায়। সার্চ করা হল পুরো বাড়ি। এটা-ওটা জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তারা বাড়ির সব ছেলেদেরকে টেনে বের করে নিয়ে গেল সামনের একটি মাঠে। মাঠে দাঁড় করিয়ে সবার পরিচয় জিজ্ঞেস করল তারা। মোস্তফা ও মনজুর সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে নিজেদের কার্ড বের করে তাদেরকে দেখালেন। সাথে সাথেই সেখানকার একজন আর্মি অফিসার অত্যন্ত বিনয়ের সাথে ক্ষমা চেয়ে সবাইকে ছেড়ে দিল। এই ঘটনায় মোস্তফা তাঁর সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে আরো গর্বিত হয়ে উঠেছিলেন। আরো নির্ভয় হয়েছিলেন। কিন্তু হায়! তাঁর এই বিশ্বাসের স্থায়িত্বকাল ছিল মাত্র এক সপ্তাহ। তারপরই হারিয়ে যান আ ন ম গোলাম মোস্তফা। গোলাম মোস্তফার জন্ম বাংলা ১৩৪৮ সালের ২৪ অগ্রহায়ণ। পিতা জহিরউদ্দিন আহমেদ। জহির উদ্দিন ছিলেন আইনজীবী সহকারী। মা গৃহিনী। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মোস্তফাই ছিলেন সবার বড়। অন্য চার ভাই হলেন আ ন ম গোলাম রব্বানী, আ ন ম গোলাম রহমান, আ ন ম গোলাম মোর্তজা, আ ন ম গোলাম কিবরিয়া। গোলাম মোস্তফা খুব অল্প বয়সেই নিজের মাকে হারান। ভাই গোলাম কিবরিয়ার জন্মের কিছুদিন পরই তাঁর মা মারা যান। পরে বাবা জহির উদ্দিন পুনরায় নিজের এক শ্যালিকাকে বিয়ে করেন। তিনি সন্তানদের মাতৃস্নেহে বড় করে তোলেন।
গোলাম মোস্তফার শিক্ষাজীবন শুরু হয় মেলাপাঙ্গা মাদ্রাসায়। সেখানে কিছুদিন পড়ার পর তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দিনাজপুর জেলা স্কুলে। স্কুলে পড়াকালীন ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতির সাথে। দিনাজপুর জেলা স্কুলে পড়ার সময়ই ছাত্র সংসদের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। কিন্তু আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে তত্‍কালীন সময়ে দিনাজপুর শহরে ব্যাপক ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার কারণে জেলার তত্‍কালীন অধিকর্তা এবং সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যক্ষ তাঁর প্রতি বিরূপ ছিলেন। ১৯৬০ সালে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং ১৯৬৩- তে একই কলেজ থেকে বি.এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পাকিস্তান বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনি অন্যতম ছাত্রনেতার ভূমিকা পালন করেন। তত্‍কালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জেলা শাখার যুগ্ম-সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৬২-তে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন সারা দেশে ছাত্রসমাজকে উদ্দীপ্ত করে তোলে, দিনাজপুরে সে আন্দোলন সংঘটিত করার ক্ষেত্রে গোলাম মোস্তফার ছিল ব্যাপক ভূমিকা। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন। একটানা প্রায় আট মাস বিনা বিচারে কারাগারে আটক থাকেন। মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় ছাত্র আন্দোলনে দ্বিগুণ মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেন। ফলে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তাঁকে আবার গ্রেফতার করে।
দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়ার সময়ই গোলাম মোস্তফা সাহিত্যচর্চার ব্যাপারেও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সাহিত্যচর্চার জন্য দিনাজপুর শহরে তিনি ছিলেন পরিচিত মুখ। এ সময় তিনি স্থানীয় সাহিত্য আন্দোলনেরও নেতৃত্ব দেন। সাহিত্যচর্চা ও রাজনীতির প্রতি একাগ্রতার কারণে এক সময় তিনি চলে আসেন ঢাকায়। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনেও তাঁর ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাশেদ খান মেনন গ্রুপের সাথে যুক্ত হন এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর কেন্দ্রীয় ছাত্র আন্দোলনের সাথে সক্রিয় হবার পাশাপাশি সাংবাদিকতা পেশায়ও তিনি মনোযোগ দেন। সাংবাদিকতা শুরু করেন 'দৈনিক সংবাদ'-এর বার্তা বিভাগে। কিছুদিন সংবাদে কাজ করার পর চলে যান 'দৈনিক আজাদ' পত্রিকায়। সেখানে তিনি সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পাশাপাশি মাসিক 'মোহাম্মদী'র সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করতেন। এ সময় নিজের সম্পাদনায় বের করতেন সাহিত্য পত্রিকা 'অন্তরঙ্গ'। ছাত্র আন্দোলন, সাংবাদিকতা, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, নিজের লেখাপড়া সবকিছুতেই তিনি একসাথে সক্রিয় ছিলেন। কোনো কাজেই তাঁর অবহেলার কথা কেউ কখনো বলতে পারত না। বরং এটিই ছিল তাঁর বিশেষ গুণ। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ. পাশ করেন। ১৯৬৯-এর আগস্ট মাসে 'দৈনিক পূর্বদেশ'-এ সিনিয়র সাব-এডিটর হিসাবে যোগদান করেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এখানেই ছিলেন। গোলাম মোস্তফা রচিত দুটি পুস্তকের মধ্যে আছে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাত্‍কার সম্বলিত 'অন্তরঙ্গ আলোকে' এবং অনুবাদ গ্রন্থ 'শ্বেত কুণ্ডলা'।
১৯৭০ সালের ১৬ জানুয়ারি গোলাম মোস্তফা বিয়ে করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেয়ে রেহানা আখতার ঝর্ণাকে। তিনি ছিলেন মোস্তফার সহকর্মী ও বন্ধু মনজুর আহমদের শ্যালিকা। এই দম্পতির দুই ছেলেমেয়ে। ছেলে অভি ও মেয়ে ঊর্মি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর থেকেই মোস্তফা ছিল বেশ উত্তেজিত। আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নির্বাচনে জয় লাভ করে। অফিসে আড্ডায় সমমনা বন্ধুদের দেখলেই তিনি বলতেন, এবার বাঙালীকে তার হিস্যা বুঝিয়ে দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ যখন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন, সেদিন তিনি সেখানে যান। মোস্তফার ধারণা ছিল এবার আর বাঙালির হাতে ক্ষমতা না দিয়ে পারবে না 'ইয়াহিয়া-ভুট্টো'। ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী যখন ঢাকায় অপারেশন সার্চ লাইটের মাধ্যমে গণহত্যা শুরু করল, তখন তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন বাঙালীর স্বাধীনতার ব্যাপারে। স্ত্রীকে বললেন, 'ঝর্ণা, যুদ্ধ কিন্তু শুরু হয়ে গেল।'
২৫ মার্চ। মোস্তফা তখন পবিবার নিয়ে থাকতেন গোপীবাগ রেল লাইনের পাশেই। ২৫ মার্চ যখন 'অপারেশন সার্চ লাইট' শুরু হল তখন গোলাগুলির শব্দে পরিবারের সবার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মোস্তফা তাঁর ভাইদের নিয়ে ছাদের উপরে গেলেন। দেখলেন চারদিকে আগুনের কুণ্ডলি আর ধোঁয়া। নিজের ঘরে ফিরে 'পূর্বদেশ' অফিসে ফোন করলেন কিন্তু কোনো উত্তর পেলেন না। একইভাবে অনেক জায়গাতেই ফোন করার চেষ্টা করলেন কিন্তু কোনো খবর পেলেন না। বাসার পাশে ছিল একটা বস্তি। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী এক সময় সেই বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। বস্তিবাসীরা চিত্‍কার শুরু করে। তখন মোস্তফা বাড়ির সব আলো নিভিয়ে দিয়ে ডাইনিং রুমে সবাইকে নিয়ে রাত কাটালেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল সন্তান অভিকে নিয়ে। ভয়ে সে একটু পরপরই কেঁদে উঠছিল। বাবা-মা তখন ছেলের মুখ চেপে রাখছিল যেন তার কান্নার শব্দ কিছুতেই বাইরে যেতে না পারে।
এই অবস্থায় সারা রাত কাটিয়ে পরদিন সকালেই মোস্তফা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পরিকল্পনা করেন। ঢাকা শহর ছেড়ে তখন অনেকেই গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। মোস্তফা পরিবারের সবাইকে নিয়ে রওনা দিলেন অজানার উদ্দেশ্যে। বাসা থেকে বেরিয়েই দেখেন সামনের খোলা মাঠে কতগুলো মৃতদেহ পড়ে আছে। বোঝার বাকি রইল না, পাকিস্তানী বাহিনী এদেরকে ধরে এনে এখানে সারিবদ্ধভাবে গুলি করে হত্যা করেছে। গোপীবাগ থেকে হেঁটে হেঁটে খানিকটা দূর যাওয়ার পরই পথে পরিচয় হয় আজিজ নামে এক যুবকের সাথে। তাকে মোস্তফা চিনেন না। তবু ওই যুবকই মোস্তফার পরিবারকে তাদের বেগুনবাড়ির বাড়িতে নিয়ে আশ্রয় দিল। তারপর প্রায় এক মাস মোস্তফা সেখানেই ছিলেন। সেখান থেকেই প্রতিদিন মতিঝিলের অফিসে যাতায়াত করতেন। এপ্রিলের শেষের দিকে আবার গোপীবাগের বাসায় ফিরে আসেন।
যুদ্ধের এই ভয়াবহতার মধ্যেও মোস্তফা ছিলেন অকপট। 'দেশ স্বাধীন হচ্ছে'- এই কথা তিনি স্থান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে চড়া গলায় বলে বেড়াতেন। যুদ্ধের সময় মানুষ যখন ফিসফিস করে কথা বলত তখন মোস্তফা বলতেন চিত্‍কার করে। বন্ধুরা আস্তে কথা বলার উপদেশ দিলেও, মোস্তফা তাতে কান দিতেন না। মনে করতেন তাঁর কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে না। এই সময়ে বাড়ির সকলকে তিনি আশ্বাস দিয়েছিলেন ভয় না পেতে। কারণ পাকিস্তান সরকার কথা দিয়েছে সাংবাদিকদের কোনো ক্ষতি করবে না।
হয়তো সরকারের এই আশ্বাস ও নিজের উপর গভীর আস্থার কারণেই মোস্তফা দেশ ছাড়তে রাজি ছিলেন না। অবশ্য কতগুলো বাস্তব সমস্যাও তাঁর ছিল। পরিচিত বন্ধুরা যখন একে-একে দেশ ছেড়ে যাচ্ছিলেন তখন অনেকে তাঁকেও চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু মোস্তফার কথা ছিল, 'আমি কি করে পালাব, আমার বাড়িতে ন'মাসের শিশু থেকে আশি বছরের বৃদ্ধা রয়েছেন। এদের আমি কার কাছে রেখে যাব। তার উপর আমার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা।'
মোস্তফার পালিয়ে না যাওয়ার পেছনে আরো একটা কারণ ছিল। ঢাকায় থেকেই তিনি তখন মুক্তিযোদ্ধাদের নানাভাবে সহযোগিতা করছিলেন। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা ঢাকায় আসত তাদের অনেকের সঙ্গেই মোস্তফা নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার, অর্থ, ঔষধসহ নানা জিনিস তিনি বিভিন্নজনের কাছ থেকে সংগ্রহ করে তাদের হাতে তুলে দিতেন। মোস্তফার ভাবনা ছিল সবাই যদি দেশত্যাগ করে তাহলে দেশের ভিতরে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করবে কে? যারা যুদ্ধ করছে তাদের কাজটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নানাভাবে সহযোগিতা করাটাও গুরুত্বপূর্ণ।
'দৈনিক পূর্বদেশ' পত্রিকায় মোস্তফা সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের সময় তিনি সংবাদ নিয়েও সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকদের সাথে কথা বলতেন। মোস্তফা চাইতেন না, পূর্বদেশ পত্রিকায় পাকিস্তানিদের কোনো খবরাখবর যাক। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে অনেকের তর্ক-বিতর্ক হতো এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই মোস্তফার এই আচরণ পাকিস্তান-ভক্ত ব্যক্তিরা মেনে নিতে পারত না। অনেকের ধারণা পাকিস্তান-ভক্ত এই ব্যক্তিরা পূর্বদেশে কর্মরত সকল স্বাধীনতাপন্থী সাংবাদিকদের খবরাখবর পাক হানাদার বাহিনীর কাছে পৌঁছে দিত।
মোস্তফা কখনো ভাগ্য বিশ্বাস করতেন না। বলতেন তাঁর ভাগ্য তাঁর নিয়ন্ত্রণে। মোস্তফার হাতের ভাগ্যরেখাটা ছিল স্পষ্ট এবং সোজা। তাই নিয়ে নিজেই বলতেন- 'আমার সাফল্যকে কে রুখবে? এমন ভাগ্যরেখা আর কারো আছে?' নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে মোস্তফার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাংবাদিক বোরহান আহমেদ একদিন বাসায় বেড়াতে এসে কৌতুহলবশত মোস্তফার হাত দেখেছিলেন। তিনি মোস্তফাকে বলেছিলেন, 'তুমি একদিন খুব বিখ্যাত হবে, তোমার খুব নাম ডাক হবে।' এর মাস খানেকের মধ্যেই পাকহানাদাররা মোস্তফাকে তুলে নিয়ে যায়।
সেদিন ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। মোস্তফা অফিস থেকে ফিরে দেখেন অভি খুব কান্নাকাটি করছে। সন্তান সম্ভাবা স্ত্রী ঝর্ণাও একটু অসুস্থ ছিলেন। পরিবারের কেউই অভিকে শান্ত করতে পারছিল না। কিছুতেই সে রাত্রে অভিকে ঘুম পাড়ানো যাচ্ছিল না। বাবার কোল আঁকড়ে ধরে নয় মাসের অভি কেঁদে একাকার হচ্ছিল। বাড়ির সবাই অস্থির হয়ে উঠেছিল ওর কান্নায়। কিন্তু কেউ কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিল না। এভাবে কাঁদতে কাঁদতে ভোর রাতের দিকে এক সময় অভি বাবার কোলেই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লেও তাঁকে বিছানায় শোয়ানো গেল না। মোস্তফার কোল থেকেও নামানো গেল না। এ অবস্থায় মোস্তফা অভিকে কোলে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। ভোর চারটার দিকে অভি আবার কাঁদতে শুরু করল। মোস্তফা আবার তাড়াতাড়ি অভিকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বারান্দায়। তখন সুবেহ্ সাদিকের সময়। ঢাকার বিভিন্ন মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসছে আজানের ধ্বনি। তখনো অন্ধকার কাটেনি। মোস্তফার বাবা জহির উদ্দিন সাহেব প্রতিদিনকার মতো নামাজ পড়ার জন্য উঠলেন। মোস্তফা বাড়ির লনে হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন অভিকে কোলে নিয়ে। ঝর্ণাসহ আর সবাই তখন ঘুমে।
এমন সময় দশ-বারজন লোক এসে বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়াল। তাদের সকলেরই পরনে ইউনিফর্ম, হাতে বন্দুক। হুটহাট করে দু'জন লোক গেইট খুলে বাড়ির ভিতরে ঢুকে যায়। মোস্তফার বাবা তখন বারান্দায় দাঁড়ানো ছিলেন। লোকগুলি জহিরউদ্দিন আহমদকে জিজ্ঞেস করে, 'এটা কি মোস্তফা সাহেবের বাড়ি? মোস্তফা কোথায়?' এই প্রশ্নগুলো শুধু শুধুই করা হয়েছিল। কারণ বাড়িটা যে মোস্তফার এটা তারা নিশ্চিতই ছিল। কারণ পাকহানাদার ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা প্রথমে মোস্তফার সম্বন্ধীকে বাড়ি চেনানোর জন্য সাথে নিয়ে আসে। তাঁর মাধ্যমেই হানাদাররা মোস্তফার বাড়িতে আসে।
হানাদাররা যখন জহিরউদ্দিন আহমদের সাথে কথা বলছিল তখন মোস্তফা নিজেই এগিয়ে আসেন। তাঁর কোলে অভি। তিনি নিজেই বললেন, 'আমিই মোস্তফা'। ওরা বলে, 'আমাদের সাথে একটু আসুন। বাচ্চাকে রেখে আসুন। ভয়ের কিছু নেই। আমরা আপনাকে 'পূর্বদেশ' অফিসে নিয়ে যাবো। ওখানে আপনার পরিচয়পত্র কার্ডটা একটু পরীক্ষা করব।' মোস্তফা বললেন, 'আমার পরিচয়পত্র কার্ড সাথে আছে।' ওরা বলল, 'তারপরও আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।' মোস্তফা কোনরকম ভয় বা আতঙ্কিত না হয়েই অভিকে বাবার কোলে রেখে ওদের সাথে বেরিয়ে গেলেন। কারণ উনি তো জানতেন সাংবাদিকদের কেউ কোনো ক্ষতি করবে না। পরনে যে পাজামা-পাঞ্জাবি ছিল সেভাবেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। একবার নিজের ঘরেও গেলেন না।
মোস্তফার স্ত্রী ঝর্ণা হঠাত্‍ ঘুম ভেঙ্গে দেখেন তাঁর ভাই শামসুদোহা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে দাড়ি কামাচ্ছেন। এত সকালে তাঁকে দেখে তিনি একটু অবাকই হন। শামসুদোহা সাহেবই প্রথম ঝর্ণাকে জানান যে, মোস্তফাকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে 'পূর্বদেশ' অফিসে। এদিকে জহিরউদ্দিন সাহেবও অন্য ছেলেদের ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। সাথে সাথে মোস্তফার ছোট ভাই 'পূর্বদেশ' অফিসে গেলেন তাঁর খোঁজে। গিয়ে জানতে পারলেন, না ওখানে মোস্তফাকে নিয়ে যায়নি কেউ। অফিসে মোস্তফার সহকর্মীরা তখনো সবাই আসেনি। কিন্তু যারাই এসেছে তারা অন্য সহকর্মীদেরও কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল। কিন্তু কেউ বলতে পারল না কোথায় নিয়ে যাওয়া হতে পারে মোস্তফাকে। এরই মধ্যে দশটা বাজার সাথে সাথে কার্ফু জারি হয়ে গেল। ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ পর্যন্ত এভাবে প্রতিদিন দু'ঘন্টা বিরতি দিয়ে এক নাগাড়ে কার্ফ্যু চলল। কিন্তু যথাসাধ্য খোঁজাখুঁজির পরও আর পাওয়া গেল না মোস্তফাকে। মোস্তফা নিখোঁজ হওয়ার পর তাঁর এক বন্ধু জানান, আসলে মোস্তফার পরের দিনই ঢাকা ছেড়ে চলে যাবার কথা ছিল। কিন্তু ঘাতকরা তাঁকে আর সে সুযোগ দেয়নি।
স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই মারা যান তাঁর বাবা জহিরউদ্দিন আহমদ। তার পরের বছর মা-ও মারা যান। মোস্তফার স্ত্রী ঝর্ণা তখনো পর্যন্ত মোস্তফার পরিবারের সাথেই ছিলেন। কিন্তু একে একে অন্য ভাইয়েরা সবাই একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে বেরিয়ে পড়েন। স্বাধীনতার পর সরকার ও 'পূর্বদেশ' পত্রিকা অফিস থেকে যে অনুদান পাওয়া গিয়েছিল তা দিয়ে মোস্তফাদের গ্রামের বাড়ি ঠিকঠাক করা হলো। কিন্তু সেই বাড়িতে মোস্তফার স্ত্রী বা তাঁর দু'সন্তানদের জায়গা হল না। তাঁরা গিয়ে উঠলেন ঝর্ণার বাবার বাড়িতে। এর মধ্য দিয়েই একসময় মোস্তফার স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে মোস্তফার পরিবারের সম্পর্কের ইতি ঘটে।
স্বাধীনতার পর ঝর্ণা তাঁর বাবার বাড়ির সহযোগিতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে সন্তানদের মানুষ করে তোলেন। নিজেও 'প্রেস ইন্সটিটিউট অফ বাংলাদেশ'-এ চাকরি নেন। মোস্তফার ছেলে অভি শিক্ষকতা করেন, মেয়ে উর্মি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম : গোলাম মোস্তফার জন্ম বাংলা ১৩৪৮ সালের ২৪ অগ্রহায়ণ। পিতা জহিরউদ্দিন আহমেদ। জহির উদ্দিন ছিলেন আইনজীবী সহকারী। মা গৃহিণী। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মোস্তফাই ছিলেন সবার বড়।
লেখাপড়া : গোলাম মোস্তফার শিক্ষাজীবন শুরু হয় মেলাপাঙ্গা মাদ্রাসায়। সেখানে কিছুদিন পড়ার পর তাঁকে পাঠিয়ে দেয়া হয় দিনাজপুর জেলা স্কুলে। ১৯৫৮ সালে দিনাজপুর জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হন সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। ১৯৬০ সালে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং ১৯৬৩-তে একই কলেজ থেকে বি.এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ. পাশ করেন।
রাজনীতি : স্কুলে পড়াকালীন সময়েই ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতির সাথে। দিনাজপুর জেলা স্কুলে পড়ার সময়ই ছাত্র সংসদের সম্পাদক নির্বাচিত হন। তত্‍কালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জেলা শাখার যুগ্ম-সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে ছাত্র ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপের সাথে যুক্ত হন এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সংসদের সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন।
গ্রেফতার : ১৯৬২-তে আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন সারাদেশে ছাত্রসমাজকে উদ্দীপ্ত করে তোলে দিনাজপুরে সে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন। একটানা প্রায় আট মাস বিনা বিচারে কারাগারে আটক থাকেন। মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় ছাত্র আন্দোলনে দ্বিগুণ মাত্রায় সক্রিয় হয়ে উঠেন। ফলে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তাঁকে আবার গ্রেফতার করে।
কর্মক্ষেত্র : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর সাংবাদিকতা পেশায় তিনি আরো মনোযোগ দেন। সাংবাদিকতা শুরু করেন 'দৈনিক সংবাদ'-এর বার্তা বিভাগে। কিছুদিন 'সংবাদ'-এ কাজ করার পর চলে যান 'দৈনিক আজাদ' পত্রিকায়। সেখানে তিনি সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পাশাপাশি মাসিক 'মোহাম্মদী'র সম্পাদনার দায়িত্বও পালন করতেন। ১৯৬৯-এর আগস্ট মাসে 'দৈনিক পূর্বদেশ'-এ সিনিয়র সাব-এডিটর হিসাবে যোগদান করেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এখানেই ছিলেন।
সাহিত্যকর্ম : 'অন্তরঙ্গ' নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। গোলাম মোস্তফা রচিত দু'টি পুস্তকের মধ্যে আছে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাত্‍কার সম্বলিত 'অন্তরঙ্গ আলোকে' এবং অনুবাদ গ্রন্থ 'শ্বেত কুণ্ডলা'।
পরিবার : স্ত্রী রেহানা আখতার ঝর্ণা। এক ছেলে অভি ও এক মেয়ে ঊর্মি।
মৃত্যু: ১০ ডিসেম্বর খুব ভোরবেলায় মোস্তফাকে তাঁর গোপীবাগের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : গুণীজন / www.gunijan.org.bd

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন